রাজধানীর একটি স্কুলের নবম শ্রেণিতে পড়ে আনিকা (ছদ্মনাম)। এখন যেহেতু অনলাইনে ক্লাস হয়, পড়াশোনার জন্যই কিছুদিন আগে হোয়াটসঅ্যাপ অ্যাকাউন্ট খুলেছিল সে। পরবর্তী সময়ে কীভাবে যেন তার নম্বর ছড়িয়ে পড়ে নানা জায়গায়। অপরিচিত নম্বর থেকে ফোন আসতে শুরু করে। ফোন ধরলে অপর প্রান্ত থেকে ভেসে আসে নানা আপত্তিকর কথাবার্তা। আনিকা জানতে পারে, ইমো অ্যাপের একটি গ্রুপেও ছড়িয়ে গেছে তার নম্বর।

আনিকা বলছিল, ‘শুরুতে খুব ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। পরে আমার বড় বোনকে বিষয়টা বলি। বোনের সাহায্য নিয়েই উত্ত্যক্তকারীদের নম্বরগুলো ব্লক করে দিই।’

দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী অর্ধেকের বেশি নারী ও মেয়ে প্রতিনিয়ত এমন বাজে অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হচ্ছে। অনলাইনে হয়রানি ও সহিংসতার মাত্রা বুঝতে প্রথম আলো ও বেসরকারি সংস্থা প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ গত ২১ থেকে ২৮ অক্টোবর পর্যন্ত অনলাইনে একটি জরিপ পরিচালনা করে। জরিপের তথ্য অনুযায়ী, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহারকারীদের মধ্যে ৭৯ শতাংশের বেশি কখনো না কখনো অনলাইনে হয়রানি ও সহিংসতার শিকার হয়েছে। এর মধ্যে নারী প্রায় ৫৩ শতাংশ। এই নারীদের বেশির ভাগ আপত্তিকর ও অপমানজনক মন্তব্যের শিকার হন। প্রথম আলোর ওয়েবসাইট ও ফেসবুক পেজে এবং প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের ফেসবুক পেজের মাধ্যমে জরিপটি চালানো হয়।

গত বছর কুমিল্লার এক কিশোরের কাছ থেকে ফেসবুকে নানা রকম অশ্লীল বার্তা পেয়েছিলেন রাজধানীর একটি বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া শিক্ষার্থী মুমতাজ মুমু। তিনি বলেন, মেসেজের উত্তর না দেওয়ার কারণে তাঁকে ধর্ষণের হুমকিও দেওয়া হয়। এরপর বন্ধুদের পরামর্শে মুঠোফোনে পুলিশের সহায়তা চান তিনি। মুঠোফোনে এই সমস্যার সমাধান সম্ভব নয় বলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরামর্শে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কার্যালয়ে যান তিনি। এরপর সেখানকার কর্মকর্তারা তাঁকে জানান, শুধু মেসেঞ্জারের কিছু বার্তার ওপর ভিত্তি করে অভিযোগ দায়ের করা যাবে না। তাই অভিযুক্ত ব্যক্তির ফেসবুক আইডি ব্লক করে দিয়ে সমস্যা সমাধান করার পরামর্শ দেন দায়িত্বরত পুলিশ কর্মকর্তারা।

আক্ষেপ নিয়ে তিনি বলেন, ‘পুলিশের কাছে হয়তো প্রতিদিন আমার মতো এ রকম হাজারো অভিযোগ আসে। বড় কেসগুলো নিয়ে তাদের অনেক ব্যস্ত থাকতে হয়। কিন্তু আমার সঙ্গে যেসব বাজে ঘটনা ঘটেছে, এগুলোও তো বিচারের যোগ্য।’

প্রথম আলো ও প্ল্যান ইন্টারন্যাশনালের ওই জরিপে অংশ নেওয়া নারী-পুরুষেরা বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনুমতি ছাড়া ব্যক্তিগত ছবি ও ভিডিও প্রচার, ভুয়া আইডি খোলা, শরীর ও পোশাক নিয়ে অশালীন মন্তব্য, যৌন ও শারীরিক নির্যাতনের হুমকি, ব্ল্যাকমেইল ইত্যাদি হয়রানির শিকার হয়েছেন বলে জানান। তুলনামূলকভাবে নারীরাই সবচেয়ে বেশি এ ধরনের তিক্ত অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছেন।

প্রযুক্তির সহজলভ্যতা আর যোগাযোগের সুবিধার্থে সব বয়সী মানুষের হাতে পৌঁছে গেছে ইন্টারনেট। যার ফলাফল সব ক্ষেত্রে ইতিবাচক নয়। কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে সাইবার বুলিং প্রতিরোধে কাজ করছে সাইবার টিনস নামের দেশীয় একটি অ্যাপ। অ্যাপটির প্রতিষ্ঠাতা নড়াইল আবদুল হাই সিটি কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র সাদাত রহমান ১৩ নভেম্বর আন্তর্জাতিক শিশু শান্তি পুরস্কার পেয়েছে। মুঠোফোনে কথা হলো সাদাতের সঙ্গে। সাদাত বলছিল, ‘পর্নোগ্রাফি আসক্তি থেকেই এ রকম সাইবার অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে অধিকাংশ কিশোর। ফলে তারা অনলাইন মাধ্যমে নারীদের সঙ্গে বিকৃত আচরণ করে। অনলাইন দুনিয়ায় এই শ্রেণির ব্যক্তিদের বেশ প্রভাবশালী মনে হলেও বাস্তবে তারা একধরনের হীনম্মন্যতা ও যৌন হতাশায় ভোগে।’

ছেলেদের কাছ থেকে সাধারণত ফেসবুক আইডি হ্যাকসংক্রান্ত অভিযোগ পায় সাদাতেরা। তবে মেয়েদের ক্ষেত্রে যৌন হয়রানি, অশ্লীল বার্তা, আপত্তিকর ছবি বা ভিডিও দিয়ে ব্ল্যাকমেইলের মতো অভিযোগই বেশি আসে সাদাতদের অ্যাপে। সাদাত জানাল, প্রেমের সম্পর্ক থেকেও অনেক সময় মেয়েরা বিভিন্ন ধরনের হুমকির শিকার হচ্ছে। তাই অনলাইনে বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে সম্পর্কে জড়ানো ও ব্যক্তিগত ছবি শেয়ার করার ক্ষেত্রে সাবধানী হওয়ার পরামর্শ দেয় সাদাত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *