সৌদি সরকারের পক্ষ থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ছুটির মেয়াদ বাড়ানো হয়েছিল, যা আজ ৩০ সেপ্টেম্বর শেষ হয়ে যাচ্ছে।
এর আগে উড়োজাহাজের টিকিটের দাবিতে ২১ সেপ্টেম্বর থেকে রাস্তায় নামেন প্রবাসী কর্মীরা। এরপর ২৩ সেপ্টেম্বর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, নতুন করে ২৪ অক্টোবর পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। এমন সিদ্ধান্তে প্রবাসী বাংলাদেশিদের ভিসা ও ইকামার (কাজের বৈধ অনুমতিপত্র) মেয়াদ আরও ২৪ দিন বাড়ানোর সুযোগ তৈরি হয়। তবে সৌদি আরবে ভিসা প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত এজেন্সি ও বাংলাদেশ দূতাবাসের সূত্র বলছে, আনুষ্ঠানিকভাবে এখন পর্যন্ত নতুন করে ছুটির মেয়াদ বাড়ানো হয়নি। সরকারিভাবে মেয়াদ বাড়ানোর কথা বলা হলেও তা আসলে মুখে মুখে। সৌদি সরকারের পক্ষ থেকে কেন্দ্রীয়ভাবে কারও মেয়াদ বাড়েনি এবার। সবাইকে আলাদা করে কফিলের সঙ্গে যোগাযোগ করে মেয়াদ বাড়িয়ে নিতে হবে।
এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে প্রথম আলোকে বলেন, নতুন সিদ্ধান্তের বিষয়টি হালনাগাদ করে সমস্যা সমাধানের জন্য ঢাকায় সৌদি দূতাবাস ও রিয়াদে বাংলাদেশ দূতাবাস সৌদি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলছে।
ছুটি ও ফিরতি ভিসার জটিলতা:
ঢাকা ও রিয়াদের কূটনৈতিক সূত্র বলছে, ছুটিতে যাওয়ার সময় সব প্রবাসী কর্মীকে ‘এক্সিট রিএন্ট্রি ভিসা’ বা পুনরায় প্রবেশের ভিসা নিয়ে যেতে হয়। ছুটি যত দিনের, এ ভিসাও তত দিনের থাকে। তাই নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই ফিরে যেতে হয়। কফিল ছুটি বাড়ালে ভিসার মেয়াদও বেড়ে যায়। কারও যদি ইকামার মেয়াদ শেষ হয়ে যায়, তাও বাড়িয়ে নিতে হয়। এসব কাজ অনলাইনে করতে পারেন কফিল। কিন্তু করোনার জন্য লাখো কর্মী আটকা পড়েছেন। তাঁদের সবারই ছুটির মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। এঁদের জন্য অন্তত ৫০ হাজার কফিলকে আলাদা করে আবেদন করতে হবে। তাই কফিলদের পক্ষ থেকে সৌদি সরকার স্বয়ংক্রিয়ভাবে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মেয়াদ বাড়িয়ে দেয়। এখন সবাইকে কফিলের সঙ্গে যোগাযোগ করে নিজ নিজ ছুটির মেয়াদ ও প্রযোজ্য ক্ষেত্রে ইকামার মেয়াদ বাড়াতে হবে।
প্রবাসীরা বলছেন, সবার কফিল ভালো নয়। তাই স্বয়ংক্রিয়ভাবে না বাড়ালে সবার মেয়াদ বাড়বে না। ইকামার জন্য সৌদি সরকারের বিভিন্ন ফি আছে। আবার অনেক প্রবাসী টাকার বিনিময়ে কফিলের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ থাকেন। এক বছরের ইকামার জন্য অনেক প্রবাসী কফিলকে ৫ থেকে ৬ হাজার রিয়াল (১ লাখ থেকে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা) দিয়ে থাকেন। তাই কর্মীর অনুপস্থিতিতে ইকামার মেয়াদ বাড়ানোর ঝুঁকি নিতে চাইবেন না কফিলরা।
এ বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন প্রথম আলোকে বলেন, সৌদি আরব বলেছে, ২৪ অক্টোবর পর্যন্ত ইকামার মেয়াদ বাড়িয়ে দেবে। ছুটির মেয়াদ বাড়াতে হলে কর্মীদের তাঁর কফিলকে রাজি করাতে হবে। এ ক্ষেত্রে সৌদি সরকারের কিছু করার নেই। তবু চেষ্টা চলছে। আজ মধ্যপ্রাচ্যের সব রাষ্ট্রদূতদের ডাকা হয়েছে।
ভিড় বাড়ছে ভিসা সেন্টারে:
সৌদি ফেরার উপায় বের করতে এক সপ্তাহ ধরে নানা দিকে ছুটছেন প্রবাসী কর্মীরা। বাড়তি টাকায় টিকিট সংগ্রহ করার চেষ্টা করছেন কেউ। আবার ভিসার মেয়াদ বাড়াতে সৌদি দূতাবাসের অনুমোদিত ভিসা সেন্টারেও ভিড় করছেন অনেকে। এমন ৩১টি ভিসা সেন্টার আছে ঢাকায়। এসব সেন্টারের কর্মী পরিচয়ে প্রবাসীদের কাছ থেকে বাড়তি টাকা নেওয়ার অভিযোগ আছে। এসব সেন্টারের মালিকেরা বলছেন, দূতাবাস থেকে নতুন করে কোনো নির্দেশনা দেওয়া হয়নি। তাই করোনার আগের নিয়মেই রিএন্ট্রি ভিসার আবেদন করতে হবে। সে ক্ষেত্রে সৌদির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সত্যায়িত কফিলের চিঠি, সৌদির জাওয়াজাত বা পাসপোর্ট বিভাগের প্রিন্ট কপি, বৈধ ইকামার কপি লাগবে। এসব না থাকায় কোনো আবেদন জমা নিতে পারছেন না তাঁরা।
এ বিষয়ে সৌদির ভিসা সেন্টারগুলোর মালিকদের অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক কফিল উদ্দিন মজুমদার বলেন, দূতাবাস অনুমোদিত ফি ছাড়া বাড়তি টাকা নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। দালালের কাছে না গিয়ে কফিলের সঙ্গে যোগাযোগের পরামর্শ দেন তিনি।
৮ দিন ধরে রাস্তায় বিক্ষোভ:
গত সপ্তাহ থেকে রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় বিক্ষোভ করছেন সৌদিপ্রবাসীরা। সচিবালয়ের সামনে, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়, ঢাকায় সৌদি দূতাবাসের সামনেও বিক্ষোভ করেছেন তাঁরা। পররাষ্ট্র ও প্রবাসী মন্ত্রণালয়ে তাঁদের ৭ দফা দাবিও জানিয়েছেন প্রবাসী কর্মীরা। তাঁদের অন্যতম দাবি, স্বয়ংক্রিয়ভাবে ছুটির মেয়াদ তিন মাস বাড়ানো।
গতকালও বিক্ষোভ করেন কর্মীরা। প্রবাসী বেলাল হোসেন বলেন, সরকার চাইলেই সমস্যার সমাধান করতে পারে। দূতাবাস যথাযথ পদক্ষেপ নিলে সৌদি আরব অবশ্যই মেয়াদ বাড়াবে। তাদের কর্মী লাগবে।
আট দিনের বিক্ষোভে গতকালই প্রথম ব্যানার হাতে নিয়ে সার্ক ফোয়ারার সামনে সকাল ১০টার দিকে সড়ক অবরোধ করেন প্রবাসীরা। সাড়ে ১০টার দিকে মিছিল নিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দিকে যান তাঁরা। দুপুর ১২টার দিকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ভেতরে যায় প্রবাসীদের ছয় সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল। বের হয়ে প্রতিনিধিদলের সদস্য মো. মনির প্রথম আলোকে বলেন, যেসব প্রবাসীর ভিসা, ইকামা ও ছুটির মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে, তাঁদের একটি তালিকা জমা দিতে বলেছেন কর্মকর্তারা।
বিমানবন্দর সূত্র বলছে, অক্টোবরে প্রতি সপ্তাহে চারটি ফ্লাইট চালাবে সৌদিয়া। যদিও করোনার আগে সপ্তাহে ২৮টি ফ্লাইট চালাত সৌদিয়া। আর সৌদি আরবে নিয়মিত ফ্লাইট চালানোর অনুমতি পায়নি বিমান। প্রতি সপ্তাহে ৯টি করে বিশেষ ফ্লাইট চালানোর অনুমতি পেয়েছে বিমান। ফলে পুরো অক্টোবরে সৌদিয়া ও বিমান মিলে ৫২টি ফ্লাইট পরিচালনা করার কথা রয়েছে। গড়ে প্রতি ফ্লাইটে ৩০০ করে যাত্রী নিলেও যেতে পারবেন ১৫ হাজার ৬০০ কর্মী।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোকাব্বির হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, অক্টোবরে কোনো এয়ারলাইনসকেই নিয়মিত ফ্লাইটের অনুমোদন দেওয়া হয়নি বলে জানিয়েছে সৌদি কর্তৃপক্ষ। প্রতি সপ্তাহে জেদ্দায় চারটি, দাম্মামে তিনটি ও রিয়াদে দুটি করে ফ্লাইট চালানোর অনুমতি পেয়েছে বিমান।
সামনে চার অনিশ্চয়তা:
রিক্রুটিং এজেন্সি মালিকদের সংগঠন বায়রা বলছে, জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত তিন মাসে সৌদি আরব থেকে দেশে এসেছেন ৮০ হাজারের বেশি প্রবাসী। করোনা মহামারি প্রতিরোধে বিদেশি নাগরিকদের প্রবেশ বন্ধ করে দেয় দেশটি। শর্ত সাপেক্ষে ১৫ সেপ্টেম্বর থেকে বাংলাদেশি কর্মীদের ফেরার দরজা খুলে দেয় সৌদি আরব।
সামনে চার অনিশ্চয়তা দেখছেন প্রবাসীরা। এগুলো হচ্ছে ছুটির মেয়াদ না বাড়া, যথাসময়ে ফ্লাইটের টিকিট না পাওয়া, করোনার পরীক্ষা করাতে না পারা ও শীতে করোনা বাড়লে ফ্লাইট বন্ধের শঙ্কা।
এ বিষয়ে অভিবাসন খাতের বেসরকারি সংগঠন রামরুর নির্বাহী পরিচালক সি আর আবরার বলেন, সঠিক তথ্য কোনটি বা সত্য জানা যাচ্ছে না। একটা আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে। দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক যোগাযোগে বিষয়টি সুরাহার আলামত দেখা যাচ্ছে না। সংশ্লিষ্টদের অব্যবস্থাপনায় অনিশ্চয়তা তৈরি করে প্রবাসীদের হয়রানি করা হচ্ছে।