বিনা মূল্যের পাঠ্যবই বিতরণে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) থেকে মতিঝিলের আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের দূরত্ব ১ কিলোমিটারের সামান্য বেশি। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে স্কুলটি জানিয়েছে, অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত সব বই পেলেও নবম শ্রেণির বাংলা মাধ্যমের মাত্র দুটি (গণিত ও ইসলাম শিক্ষা) বই পেয়েছে তারা। আর ইংরেজি ভার্সনে সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত সব বই পেলেও অষ্টম ও নবম শ্রেণির কোনো বই এখনো পায়নি।
ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ শাহান আরা বেগম প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, দুই-তিন দিন আগে তাঁদের জানানো হয়েছে কয়েক দিনের মধ্যে সব বই চলে আসবে।
ঢাকার বাইরে বগুড়ার শাহজাহানপুর উপজেলার একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন প্রধান শিক্ষক জানালেন, গতকাল পর্যন্ত পঞ্চম শ্রেণির বাংলা, গণিত ও বিজ্ঞান এবং চতুর্থ শ্রেণির গণিত, বিজ্ঞান ও ধর্ম বই পাননি তাঁরা। শুধু এই দুটি বিদ্যালয়ই নয়, সারা দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই কমবেশি এই চিত্র। এনসিটিবির দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা এখন বই পাঠানোর সঠিক তথ্য সুনির্দিষ্ট করে জানাচ্ছেন না। তবে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র বলছে, এখন পর্যন্ত মাধ্যমিকে অন্তত প্রায় ২৫ শতাংশ বই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যায়নি। এবার মাধ্যমিকে মোট বই ২৪ কোটির বেশি। আর প্রাথমিকে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ বই মাঠপর্যায়ে যায়নি। এই স্তরে মোট বইয়ের সংখ্যা ১০ কোটির কিছু বেশি।
নিয়মানুযায়ী, ডিসেম্বরের মধ্যে কিছুসংখ্যক বাদে প্রায় সব বই উপজেলা এবং স্কুলে স্কুলে পাঠানোর কথা। কিন্তু প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে বিনা মূল্যে নতুন বই দেওয়া শুরুর পর গত ১১ বছরের মধ্যে এবারই বেশি মাত্রায় এর ব্যত্যয় ঘটছে। কারণ হিসেবে করোনাভাইরাসের প্রভাবকে বলা হলেও পাশাপাশি এনসিটিবি ও মুদ্রণকারীদের গাফিলতিও রয়েছে। এ ছাড়া কাগজের সংকটও দায়ী। এবার প্রাক্কলিত দরের চেয়ে অস্বাভাবিক কম দামে কাজ পেয়েছিল মুদ্রণকারীরা। আর যখন কাজ নিয়েছিল তখন কাগজের দাম কম ছিল। পরে আবার বাজারে কাগজের দাম বেড়ে যাওয়ায় ছাপা নিয়ে ঢিলেমি শুরু হয়। আবার এনসিটিবিও এবার কিছুটা দেরিতে কার্যাদেশ দেয়। এমনকি শেষ সময়ে বইয়ের প্রচ্ছদে কিছু সংযোজন করা হয়। ফলে ছাপার কাজে দেরি হয়।
এখন পর্যন্ত কত শতাংশ বই পাঠানোর জন্য ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে—এই প্রশ্নের জবাবে এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক নারায়ণ চন্দ্র সাহা গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, এখন আর এই হিসাব করা হচ্ছে না। এখন ১২ জানুয়ারির মধ্যে বই দেওয়ার চেষ্টা করছেন তাঁরা।
নতুন বছরের পাঁচ দিন হয়ে গেলেও সব বই দিতে না পারার বিষয়ে এনসিটিবির চেয়ারম্যান বলেন, তাঁদের লক্ষ্য ছিল ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে সব শিক্ষার্থীদের হাতে বই পৌঁছে দেওয়া। কোনো শ্রেণি যেন একেবারে শূন্য না থাকে। এখন যেসব বই যায়নি সেগুলো পাঠানো হচ্ছে। এ জন্য ছাপাখানা ধরে ধরে তদারক করা হচ্ছে।
নতুন শিক্ষাবর্ষে করোনার কারণে এবার উৎসব না করে মাধ্যমিকে প্রতিটি শ্রেণির বই তিন দিনে দেওয়া হচ্ছে। আর প্রাথমিকের বই সর্বোচ্চ তিন দিনে দেওয়ার কথা।
মাধ্যমিকের চিত্রটি তুলনামূলকভাবে বেশি খারাপ। মাধ্যমিকে এবার ৫০টি প্রতিষ্ঠান ছাপার কাজ করছে। এর মধ্যে ১০ থেকে ১২টি মুদ্রণকারী প্রতিষ্ঠান ছাপার কাজে পিছিয়ে আছে। এর মধ্যে ঢাকার বাইরের একটি মুদ্রণ প্রতিষ্ঠান আরও বেশি পিছিয়ে রয়েছে। এই প্রতিষ্ঠান কেবল মাধ্যমিকেই পৌনে এক কোটি বই ছাপার কাজ পেয়েছে।
ঢাকার গবর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাইস্কুলের একজন শিক্ষক গতকাল সন্ধ্যায় প্রথম আলোকে বলেন, অন্যান্য সব বই পেলেও সপ্তম, অষ্টম ও নবম শ্রেণির তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিষয়ের বই তাঁরা পাননি। এ বিষয়টি বাধ্যতামূলক।
এদিকে এবার নিম্নমানের কাগজে বই ছাপায় প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে কয়েক লাখ বই বাতিল করা হয়েছে। এ ছাড়া কয়েক হাজার মেট্রিক টন কাগজও বাতিল হয়েছে।
বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্প সমিতির সভাপতি শহীদ সেরনিয়াবাত প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের হিসাবে প্রাথমিকে ৮৫ শতাংশ বই চলে গেছে। আর মাধ্যমিকে আরও কম গেছে। দুটি কারণে এবার বই কিছুটা দেরিতে যাচ্ছে। প্রথমত, করোনার সংক্রমণ পরিস্থিতি, দ্বিতীয়ত এবার কাগজের মিলগুলো অগ্রিম টাকা নিয়েও সময়মতো কাগজ দেয়নি। তবে তাঁরা আশা করছেন, ১৫ থেকে ২০ জানুয়ারির মধ্যে সব বই চলে যাবে। কিন্তু আশঙ্কা হলো, এখন এনসিটিবির তদারকি যদি দুর্বল হয়, তাহলে শেষ সময়ে নিম্নমানের বই দেওয়া হতে পারে।