এটা আমাদের জানা ছিল যে এই সময়ে পরিস্থিতি শোচনীয় হতে পারে এবং জুন মাসের শেষ সপ্তাহে এসে আমরা সত্যিই এখন সেই পরিস্থিতির মুখোমুখি। দেশে করোনা সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর সর্বোচ্চসংখ্যক ১১৯ জনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে ২৪ ঘণ্টায় (২৬ জুন সকাল ৮টা থেকে ২৭ জুন সকাল ৮টা)। এর পরদিনই ২৪ ঘণ্টায় দেশে শনাক্ত হয়েছে সর্বোচ্চসংখ্যক ৮ হাজার ৩৬৪ জন রোগী। এই যে আগেভাগে আমরা জানলাম এ সময়ে পরিস্থিতি শোচনীয় হতে পারে, তা বিবেচনায় নিয়ে আমরা কী ব্যবস্থা নিয়েছিলাম?
করোনাভাইরাস নিয়ে পূর্বাভাস, ভবিষ্যদ্বাণী, সে অনুযায়ী প্রয়োজনীয় সতর্কতা ও ব্যবস্থা গ্রহণের পরামর্শের ক্ষেত্রে আমাদের জনস্বাস্থ্য ও চিকিৎসা বিশেষজ্ঞদের কোনো ঘাটতি ছিল না। সেই ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে যখন চীনের উহানে করোনার সংক্রমণ শুরু হয়েছিল, তারপর থেকেই তাঁরা নানাভাবে আমাদের সতর্ক করার চেষ্টা করেছেন। সংক্রমণ বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করলে আমাদের করণীয় কী, সে ব্যাপারে তাঁরা পরামর্শ দিয়েছেন।
করোনা সংক্রমণে ইতালি যখন বিপর্যস্ত, তখন দেশটির সঙ্গে ফ্লাইট বন্ধের পরামর্শ ছিল, তা কার্যকর হয়নি। ইতালিফেরত ব্যক্তিদের কঠোরভাবে কোয়ারেন্টিনে রাখার ব্যাপারে বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে দিয়েছিলেন, তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। করোনা টেস্টের প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নেওয়ার বিষয়ে বিশেষজ্ঞের তরফে আমরা পরামর্শ পেয়েছি। তখন ১৭ কোটি মানুষের দেশে ১ হাজার ৭০০-এর মতো টেস্ট কিট নিয়ে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলা হয়েছিল, আমরা প্রস্তুত। টেস্টের সংখ্যা বাড়ান—এসব কথা বলতে বলতে আমাদের স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মুখে ফেনা তুলে ফেলেছেন। তাঁরা বিভিন্ন সময়ে কঠোর লকডাউনের পরামর্শ দিয়েছেন। কিন্তু ২০২০ সালের মার্চ মাস থেকে এ পর্যন্ত লকডাউনের নামে আসলে কী হয়েছে?
করোনাসংক্রান্ত একটি জাতীয় পরামর্শক কমিটি গঠন করেছে সরকার। তাদের কাজ করোনা মোকাবিলায় সরকারকে পরামর্শ দেওয়া। তারা নিশ্চয়ই তা করে, তবে তারা কী পরামর্শ দেয় বা তা সরকার আদৌ বিবেচনায় নেয় কি না, সেটা আমাদের পক্ষে জানা কঠিন। সম্ভবত সেই বিবেচনার কারণেই ২৪ জুন কমিটির পক্ষ থেকে সংবাদমাধ্যমে একটি বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে। সেখানে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ও রোগের বিস্তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ায় জনগণের জীবনের ক্ষতি প্রতিরোধে সারা দেশে কমপক্ষে ১৪ দিন সম্পূর্ণ ‘শাটডাউন’-এর সুপারিশ করা হয়।
কমিটির পরামর্শ হচ্ছে এই সময়ে জরুরি সেবা ছাড়া যানবাহন, অফিস-আদালতসহ সবকিছু বন্ধ রাখা উচিত। তারা মনে করে, এ ব্যবস্থা কঠোরভাবে পালন করতে না পারলে যত প্রস্তুতিই থাকুক না কেন, স্বাস্থ্যব্যবস্থা তা সামাল দিতে পারবে না। কমিটির সভাপতি মোহাম্মদ সহিদুল্লা বিষয়টি আরও স্পষ্ট করে বলেছেন, ‘শাটডাউন মানে জরুরি সেবা ছাড়া সবকিছুই বন্ধ রাখার কথা বোঝানো হয়েছে।’
এই পরামর্শ সংবাদমাধ্যমে আসার পরপরই একে ‘যৌক্তিক’ বলে উল্লেখ করেছেন জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন। তিনি যেকোনো সময়ে তা কার্যকরের ঘোষণাও দেন। পরদিন ২৫ তারিখ শুক্রবার রাতে তথ্য অধিদপ্তরের এক বিজ্ঞপ্তির সূত্রে আমরা জানতে পারি, ২৮ তারিখ থেকে কঠোর লকডাউন কার্যকর হচ্ছে। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, লকডাউনের সময় জরুরি পরিষেবা ছাড়া সব সরকারি-বেসরকারি অফিস বন্ধ থাকবে। এর সঙ্গে জনপ্রশাসনমন্ত্রী আরও যুক্ত করে বলেছিলেন, এই লকডাউন কার্যকরে পুলিশ ও বিডিআর দায়িত্ব পালন করবে। প্রয়োজনে সেনাবাহিনীও থাকতে পারে।
শুক্রবার রাতে দেওয়া এই বিজ্ঞপ্তি ছিল স্পষ্টতই অস্পষ্ট। লোকজন ধন্দে পড়েছিল আসলে কী কী বন্ধ থাকবে বা কী কী থাকবে না, তা নিয়ে। পত্রিকা অফিসে ফোন করে অনেকে ‘সব সরকারি-বেসরকারি অফিস বন্ধ’ থাকার ব্যাখ্যা জানতে চেয়েছেন। কারও কাছে এর ব্যাখ্যা ছিল না। শনিবার প্রজ্ঞাপন দিয়ে বিস্তারিত জানানোর আশ্বাস দিয়েছিল মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। সেটা আর হয়নি। পরে সরকারের ‘দায়িত্বশীল সূত্রের’ বরাতে গণমাধ্যমগুলো জানায়, সোমবার থেকে যে ‘কঠোর’ লকডাউন হওয়ার কথা ছিল, তা হবে ‘সীমিত’ পরিসরে। আগামী ১ জুলাই বৃহস্পতিবার থেকে সাত দিনের জন্য শুরু হবে সর্বাত্মক লকডাউন। তখন জরুরি পরিষেবা ছাড়া সবই বন্ধ থাকবে।
করোনাসংক্রান্ত একটি জাতীয় পরামর্শক কমিটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে ১৪ দিনের সর্বাত্মক শাটডাউনের পরামর্শ দিয়েছিল ২৪ জুন। এর তিন দিন পর গতকাল ২৮ জুন শুরু হয়েছে গণপরিবহন, শপিং মল ও মার্কেট বন্ধের ‘সীমিত’ বিধিনিষেধ। পরশু রাতে এক টিভি টক শোতে খুলনায় করোনা চিকিৎসা কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত এক চিকিৎসা কর্মকর্তা বলছিলেন ‘সত্যিকারের লকডাউন’ করা গেলে ফল পাওয়া যেত। এখন যা চলছে, তা সম্ভবত সত্যিকারের নয়। আগামী ১ জুলাই থেকে ৭ জুলাই রাত ১২টা পর্যন্ত যে ‘কঠোর বিধিনিষেধের’ কথা গতকাল দুপুরে ঘোষণা করেছেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব, সেটাই কি তবে হতে যাচ্ছে ‘সত্যিকারের’ লকডাউন? আর মাত্র এক দিন!