বিশ্বের আদি শিক্ষক আল্লাহ তা-আলা। তাই ফেরেশতারা বলেছিলেন, ‘হে আল্লাহ, আপনি পবিত্র! আপনি যা শিখিয়েছেন তা ছাড়া আমাদের কোনোই জ্ঞান নেই; নিশ্চয় আপনি মহাজ্ঞানী ও কৌশলী।’ (সুরা-২ বাকারা)। আমাদের প্রিয় নবী (সা.)–এর প্রতি ওহির প্রথম নির্দেশ ছিল, ‘পড়ো তোমার রবের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন, সৃষ্টি করেছেন মানব “আলাক” থেকে। পড়ো, তোমার রব মহা সম্মানিত, যিনি শিক্ষাদান করেছেন লেখনীর মাধ্যমে, শিখিয়েছেন মানুষকে, যা তারা জানত না।’ (সুরা-৯৬ আলাক)। ‘দয়াময় রহমান! কোরআন শেখাবেন বলে মানব সৃষ্টি করলেন; তাকে বর্ণনা শেখালেন।’ (সুরা-৫৫ রহমান)। শিক্ষার আসল বৈশিষ্ট্য িএই একটি জায়গা থেকেই শুরু। সেই শুরু এখনও প্রতিনিধিত্ব করছেন মানুষ। অথাৎ যারা শিক্ষকতার মত মহান পেশায় নিজেকে জড়িয়ে রেখেছেন।

একজন ছাত্রকে কেবল শিক্ষিতই নয় বরং নৈতিক মানুষ করে গড়ে তোলার গুরুদায়িত্বটাও থাকে শিক্ষকের ওপরই। তাই একজন শিক্ষককে হতে হয় অনেক বেশি সচেতন, ধৈর্যশীল ও ন্যায়নিষ্ট। একজন আদর্শ শিক্ষক হতে হলে আপনাকে বিশেষ কিছু গুণের অধিকারী হতে হবে। শিক্ষাদানের প্রধান উদ্দেশ্যই হলো শিক্ষার্থীর পরিপূর্ণ জীবন বিকাশে সহায়তা প্রদান করা। এ লক্ষ্য অর্জনের পূর্বশর্ত হলো উপযুক্ত শিক্ষক। পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধি, জ্ঞানের সমন্বয় সাধন, উন্নতি ও সঠিক পন্থায় বিতরণের জন্য প্রশিক্ষণ অপরিহার্য। দরকার মেধা মনন আর জ্ঞানের গভীরতায় পরিপূণ একজন মানুষ।

যে ব্যক্তি শিক্ষক ছাড়া শুধু বই পুস্তক পড়ে বিদ্যা অর্জন করে, সে কোনো দিন শিক্ষার পুর্ণতায় পৌঁছতে পারে না। বিজ্ঞ জনেরা বলেছেন, যার কোনো শিক্ষক নেই তার শিক্ষক শয়তান। মনীষীগণ আরো বলেছেন, শিক্ষকের দৃষ্টান্ত একজন মালীর মতো। একটা বাগানের সমৃদ্ধি যেমন মালীর পুর্ণ দৃষ্টির ওপর নির্ভর করে তেমনিভাবে একজন শিক্ষার্থীর জীবনের উন্নতি-অবনতি শিক্ষকদের দৃষ্টির ওপর নির্ভরশীল। সেই অর্থে শিক্ষক হলেন একজন অভিভাবক যার হাত ধরে গড়ে উঠবে শিক্ষাথীর আসল জীবন। সে হাটতে শিখবে কথা বলতে শিখবে আর আচরণে আসবে একজন মানুষের জায়গায়।

সব পেশা হতে শ্রেষ্ঠ ও সম্মান জনক পেশা হচ্ছে শিক্ষকতা। পৃথিবীতে মানুষ যত কর্মে নিয়োজিত আছে, তার মধ্যে শিক্ষকতার শ্রেষ্ঠত্বের সঙ্গে কেউ প্রতিদ্বন্ধিতা করতে পারবে না। তাই সাহাবাদের (রা.) একটা বৃহৎ সংখ্যা শিক্ষক হিসেবে সমাজে গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিলেন। বড় বড় রাজনীতিবিদ, সমাজ সংস্কারক এবং ধর্মীয় দিক নির্দেশকের ভূমিকায় শিক্ষকরাই ছিলেন অন্যতম। এ জন্যেই ইসলাম শিক্ষককে রূহানী পিতা সাব্যস্ত করেছে। যুগে যুগে আমরাও তাই দেখে আসছি।

শিক্ষাথীর জীবনের আচরণে ইতিবাচক পরিবর্তন ও উন্নয়ন সাধনই শিক্ষার উদ্দেশ্য। নৈতিক শিক্ষার সঙ্গে যেসব বিষয় সরাসরি সম্পর্কিত: সুশাসন, ন্যায়বিচার, মানবাধিকার, দুর্নীতি দমন, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, প্রবৃদ্ধি, সন্ত্রাস দমন, শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষা। আচরণে (কর্মে) অভীষ্ট ইতিবাচক পরিবর্তন ও উন্নয়ন সাধনের জন্য নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে তথ্য প্রদান বা জ্ঞান দান করাকে শিক্ষা বলে। খলিফা হজরত উমর (রা.)-এর এক প্রশ্নের জবাবে হজরত উবায় ইবনে কাআব (রা.) বলেন, ‘ইলম হলো তিনটি বিষয়—আয়াতে মুহকামাহ (কোরআন), প্রতিষ্ঠিত সুন্নত (হাদিস) ও ন্যায় বিধান- (তিরমিজি)। হজরত ইব্রাহিম (আ.) দোয়া করলেন, ‘হে আমাদের প্রভু! আপনি তাদের মধ্যে পাঠান এমন রাসুল, যিনি তাদের সমীপে আপনার আয়াত উপস্থাপন করবেন, কিতাব ও হেকমত শিক্ষা দেবেন এবং তাদের পবিত্র করবেন। নিশ্চয় আপনি পরাক্রমশালী স্নেহশীল ও কৌশলী।’ (সুরা-২ বাকারা)

ইসলাম শান্তির ধর্ম। ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান। মানুষের ইহকালীন ও পরকালীন জীবনের যাবতীয় ক্ষেত্র এবং শিক্ষা–সম্পর্কিত দিকনির্দেশনা দেয় ইসলামের পবিত্র গ্রন্থ আল কোরআন। এই মহান গ্রন্থের নির্দেশনাকে বাস্তব ক্ষেত্রে রূপ দিয়েছেন মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)। তিনি জগৎ ও জীবনের পার্থিব ও আধ্যাত্মিক সব সমস্যার সমাধান নিজ জীবনে বাস্তবায়নের মাধ্যমে দেখিয়ে গিয়েছেন। এমন কোনো সমস্যা নেই, যা তিনি স্পর্শ করেননি এবং তিনি যা স্পর্শ করেছেন তা পরিপূর্ণভাবে সম্পন্ন করেছেন। ইসলামে বিশেষ করে আল–কোরআন ও হাদিসে জ্ঞানার্জনের প্রতি কী নির্দেশ আছে, তা জানা আবশ্যক। পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধানের উৎস পবিত্র কোরআন হলো মুসলিম বিশ্বের মূল শিক্ষাগ্রন্থ। এ গ্রন্থের বিধান থেকে শিক্ষাও বাদ যায়নি; বরং এ গ্রন্থের প্রথম আয়াত অবতীর্ণ হয় শিক্ষার দুটি দক্ষতা উল্লেখ করে; তা হলো পড়া ও লেখা।

কোরআনে রয়েছে, ‘হে প্রভু! আমার জ্ঞান বৃদ্ধি করে দাও।’ (সুরা-২০)। শিক্ষা গ্রহণ ছাড়া জ্ঞান বৃদ্ধি পেতে পারে না। মানবাত্মার সঠিক বিকাশের প্রধান উপায় হলো শিক্ষালাভে জ্ঞান বৃদ্ধির মাধ্যমে নিজের সত্তা উপলব্ধি করে জীবন সমস্যা সমাধানে দক্ষতা অর্জন করা। আল্লাহ তাআলা নবী ও রাসুলদের শিক্ষক হিসেবে পাঠিয়েছেন। প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) ও তাঁর পূর্বে প্রেরিত নবীরা সবাই ছিলেন মহান শিক্ষক। শেষ নবী (সা.)–কে জগতের উজ্জ্বল আলোকবর্তিকাস্বরূপ প্রেরণ করা হয়। আল্লাহ তাআলা স্বয়ং তাঁকে শিক্ষার বিষয়বস্তু ও পদ্ধতি শিক্ষা দিয়েছেন। শেষ নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) নিজের পরিচয় দিয়ে বলেন, ‘আমাকে শিক্ষক হিসেবেই পাঠানো হয়েছে।’ এ ক্ষেত্রে হজরত আদম (আ.)-এর শিক্ষাপদ্ধতিও উল্লেখ করা যায়। হজরত আদম (আ.) সরাসরি আল্লাহর তত্ত্বাবধানে প্রত্যক্ষভাবে প্রকৃতি সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করেন এবং ফেরেশতাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে প্রথম হয়ে মানবের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেন।
শুধু শিক্ষা দিলেই মর্যাদার অধিকারী হওয়া যায় না। বরং প্রশংসার আসনে আসীন হতে হলে শিক্ষকের জন্যেও কিছু করণীয় বিষয় রয়েছে, যেগুলো অবলম্বনে শিক্ষকতার দায়িত্ব আঞ্জাম দিলে ইহকালে পদমর্যাদার অধিকারী ও আখেরাতে বিরাট পুরস্কারে পুরস্কৃত হওয়া সম্ভব। আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টির জন্যে শিক্ষা দেয়া এবং তদনুযায়ী আমল করা। ইমাম গায্যালী রহ.  বলেন, যে ব্যক্তি ইলম অর্জন করে এবং মানুষকে শিক্ষা দান করে, আকাশ ও পৃথিবীর রাজত্বে তাকেই মহান বলা হয়। সে সূর্যের মতো অপরকে আলো দান করে এবং নিজেও আলোকময়। সে মেশকের মতো অপরকে সুগন্ধিতে আমোদিত করে এবং নিজেও সুগন্ধি যুক্ত। আর যে ব্যক্তি অপরকে শিক্ষা দান করে কিন্তু নিজে আমল করে না সে শানের মতো লোহাকে ধারালো করে কিন্তু নিজে কাটে না, সে ব্যক্তি সুচের মত যে অন্যের জন্য পোশাক তৈরী করে কিন্তু নিজে উলঙ্গ থাকে।

আমাদের মনে রাখতে হবে নিজে জানলেই কেবল অন্যকে জানানোর দায়িত্ব নেয়া যায়। আমরা নিজেরা না জানলে অন্যকে কিভাবে জানাব? প্রশ্ন থেকেই যায়। কিন্তু এই একটি কাজ আমরা করি কিনা? উত্তর না। পাঠ দানের পূর্বে পড়ানোর পদ্ধতি জানার মাধ্যমে অনুশীলন করে শ্রেণী কক্ষে যাওয়া। পড়ানো শেষ হলে শিক্ষার্থীদের চেহারার দিকে তাকানো। যদি তাদের চেহারায় আনন্দের আভা দেখা দেয় , তাহলে বুঝতে হবে যে তারা বিষয় বস্তু হৃদয়ঙ্গম করতে পেরেছে। বর্ণিত আছে, একদা গ্যালেন (হাকিম জালিনুস ) একটি জটিল বিষয়ের ক্লাস নিলেন। পাঠদান সমাপ্ত করে জিজ্ঞেস করলেন তোমরা কি বুঝেছ? শিক্ষার্থীরা হ্যাঁ বুঝেছি বলে উত্তর দিলেও তিনি মন্তব্য করলেন তোমরা বুঝনি। কারণ যদি তোমরা বুঝতে তাহলে তোমাদের চেহারায় আনন্দের আভা ফুটে উঠতো। আর যদি তাদের চেহারায় নৈরাশ্যের ছাপ থাকে তাহলে বুঝে নিতে হবে তারা সন্তুষ্ট নয়। সুতরাং শিক্ষকের উচিৎ পরবর্তিতে উক্ত বিষয়টি বুঝিয়ে দেয়া। আমরা এই কাজটি করি? করি না।

একবার হজরত জায়েদ ইবনে সাবিত রাদিয়াল্লাহু আনহু তার সওয়ারিতে ওঠার জন্য রেকাবে পা রাখলেন। তখন ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু রেকাবটি শক্ত করে ধরেন। হজরত জায়েদ ইবনে সাবিত বললেন, হে রাসুলুল্লাহ’র (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) চাচাতো ভাই, আপনি হাত সরান। উত্তরে ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, না, আলেম ও বড়দের সঙ্গে এমন সম্মানসূচক আচরণই করতে হয়। জ্ঞানই মানুষের যথার্থ শক্তি ও মুক্তির পথনির্দেশ দিতে পারে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেই বলেছেন, ‘আমাকে শিক্ষক হিসেবে প্রেরণ করা হয়েছে।’

তিনি শিক্ষা, শিক্ষা উপকরণ, শিক্ষক ও শিক্ষার ব্যাপকীকরণে সদা সচেষ্ট ছিলেন। তাইতো বদরের যুদ্ধবন্দিদের তিনি মদিনার শিশুদের শিক্ষা দেয়ার বিনিময়ে মুক্তির ব্যবস্থা করেছিলেন, যা বিশ্বের ইতিহাসে বিরল। হজরত আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, একদিন জনৈক বয়স্ক ব্যক্তি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর দরবারে হাজির হলে উপস্থিত সাহাবায়ে কিরাম নিজ স্থান থেকে সরে তাকে জায়গা করে দেন। তখন তিনি ইরশাদ করেন, `যারা ছোটদের স্নেহ ও বড়দের সম্মান করে না, তারা আমাদের দলভুক্ত নয়।` (তিরমিজি)

হজরত আদম (আ.) ছিলেন বিশ্বের প্রথম শিক্ষক। ধরায় অবতীর্ণ হয়ে তিনি আল্লাহর কাছ থেকে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে লব্ধ জ্ঞান দ্বারা তাঁর পরিবার-পরিজনকে শিক্ষা দান করেন। তাঁর স্রষ্টা ও শিক্ষকের গুণাবলি ও নির্দেশনা প্রচার করেন। হজরত মুহাম্মদ (সা.) ছিলেন বিশ্বশিক্ষক। এভাবে যুগে যুগে নবী রাসুলগন শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেছেন। আমাদের শিক্ষক সমাজও সেই দায়িত্বটাই পালন করেন। তাদের নিজের অজান্তেই তারা শ্রেষ্ঠ মানুষের জায়গায় আসীন হয়ে আছেন। তাই শিক্ষক সমাজ তাঁদের জন্য প্রাপ্ত সন্মানকে ধরে রাখতে হলে সঠিক দিকেই ধাবিত হতে হবে। জেনে জানানোর যে পদ্ধতি তাতে ফিরে আসতে হবে। এভাবেই সমাজ আলোকিত হবে। সৃষ্টি হবে নব-দিতগন্ত। যুগে যুগে শিক্ষককের হাত ধরে তৈরী হয়ে নতুন সমাজ আর পিরামিড। আগামীতে আরো সুন্দরের দিকেই আমি চেয়ে আছি। তাহলেই শিক্ষকতায় আসার স্বপ্ন পূরণ হবে।
-ডক্টর মুহাম্মদ কামাল উদ্দিন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *