সরকার শুরুতে প্রায় ৫২ লাখ মানুষকে করোনার টিকা দিতে চায়। তিনটি পর্যায়ে পাঁচ ধাপে মোট ১৩ কোটির বেশি মানুষকে বিনা মূল্যে টিকা দেওয়ার কথা ভাবছে সরকার। সুষ্ঠুভাবে টিকা কেনা, সংগ্রহ, সংরক্ষণ, পরিবহন ও বিতরণের জন্য উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত কমিটি করা হবে। সারা দেশে করোনার টিকা দেওয়ার খসড়া জাতীয় পরিকল্পনায় এ কথা বলা হয়েছে।
খসড়া পরিকল্পনায় আইনগত প্রস্তুতি, কাজের সমন্বয়, যোগাযোগ ও জনসচেতনতা সৃষ্টি, অর্থ ও জনবল, কোল্ড চেইন ও সরঞ্জাম, টিকার নিরাপত্তা, টিকা পাওয়ায় অগ্রাধিকার, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়নের মতো বিষয়গুলো রয়েছে। টিকা সংগ্রহ, টিকা কেনা ও টিকা বিতরণের খরচেরও একটি সম্ভাব্য হিসাব জাতীয় পরিকল্পনায় তুলে ধরা হয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, গত সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে একটি অনুষ্ঠানে খসড়া পরিকল্পনার মূল বিষয়বস্তু উপস্থাপন করা হয়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক মীরজাদী সেব্রিনা প্রথম আলোকে বলেন, জাতীয় পরিকল্পনা চূড়ান্ত করার কাজ প্রায় শেষ। চূড়ান্ত হলে তা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে অনুমোদনের জন্য।

কাদের টিকা দেওয়া হবে, কীভাবে টিকা দেওয়া হবে—এসব ব্যাপারে স্বচ্ছতা থাকতে হবে। টিকার কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দেয় কি না, সে বিষয়ে কঠোর নজরদারির ব্যবস্থা রাখতে হবে।
অধ্যাপক বে-নজির আহমেদ, জনস্বাস্থ্যবিদ

২২ নভেম্বর করোনাবিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সভায় এই পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা হয়। ওই দিন কমিটির সভাপতি অধ্যাপক মো. সহিদুল্লার পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, পরিকল্পনাটি সম্পূর্ণ ও যথাযথ। কমিটি এই পরিকল্পনাকে সমর্থন জানিয়েছে।
চিকিৎসক ও জনস্বাস্থ্যবিদেরা বলছেন, করোনার সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই। সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের স্থায়ী সমাধান টিকার মাধ্যমেই সম্ভব বলে ধারণা করা হচ্ছে। বিশ্বের অনেক ওষুধ কোম্পানি ও বিজ্ঞানীরা টিকা উদ্ভাবনের চেষ্টা চালাচ্ছেন। এ ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতাও লক্ষ করা যাচ্ছে। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি কোম্পানি তাদের টিকা কার্যকর ও নিরাপদ বলে দাবি করেছে। তবে এ পর্যন্ত কোনো টিকা ব্যাপক জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিতরণের আনুষ্ঠানিক অনুমোদন পায়নি।
খসড়া জাতীয় পরিকল্পনায় বলা হয়েছে, ব্যবহার উপযোগী এবং অনুমোদিত কোনো টিকা না থাকলেও বাংলাদেশ টিকা দেওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে রাখছে। টিকা পাওয়ামাত্র অল্প সময়ের মধ্যে প্রস্তুতি চূড়ান্ত করা সম্ভব হবে।
কারা টিকা পাবে
সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকা জনগোষ্ঠী থেকে শুরু করে কম ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীকে টিকার আওতায় আনা হবে। নির্ভর করবে কী পরিমাণ টিকা পাওয়া যায়, তার ওপর। পরিকল্পনায় মোট জনসংখ্যার ৮০ শতাংশকে বা ১৩ কোটি ৮২ লাখ ৪৭ হাজার ৫০৮ জনকে টিকা দেওয়ার কথা ভাবছে সরকার। তিন পর্যায়ের পাঁচ ধাপে এদের টিকা দেওয়া হবে।
প্রাথমিকভাবে সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকা জনগোষ্ঠীকে টিকা দেওয়ার ব্যাপারে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। প্রথম পর্যায়ের প্রথম ধাপে ৫১ লাখ ৮৪ হাজার ২৪২ জনকে টিকা দেওয়ার চিন্তা রয়েছে। তাঁদের মধ্যে আছেন সরকারি-বেসরকারি স্বাস্থ্যকর্মী, মুক্তিযোদ্ধা, সম্মুখ সারির আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্য, আমলা, সাংবাদিক, জনপ্রতিনিধি, সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তা-কর্মচারী, ধর্মীয় নেতা, দাফন/জানাজা ও সৎকারে জড়িত ব্যক্তি ও দীর্ঘস্থায়ী রোগে ভোগা ব্যক্তিরা টিকা পাবেন। এঁরা মোট জনসংখ্যার ৩ শতাংশ।
শিশু ও গর্ভবতী নারী টিকার আওতায় না–ও থাকতে পারে। কারণ, শিশুদের মধ্যে করোনার তীব্রতা মারাত্মকভাবে দেখা দেয়নি। অন্যদিকে গর্ভবতী মায়েদের ক্ষেত্রে টিকার কার্যকারিতা ও টিকা কতটা সফল, তা পরীক্ষা করে দেখা হয়নি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা দাবি করেছেন, করোনা টিকার ব্যাপারে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুসরণ করে জাতীয় পরিকল্পনা করা হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, করোনার টিকা বৈশ্বিক গণপণ্য। বিতরণের মূল্য উদ্দেশ্য হচ্ছে এই টিকা বিশ্বের সব মানুষকে ন্যায়সংগতভাবে সুরক্ষার পাশাপাশি কল্যাণ নিশ্চিত করবে। বিতরণের মূল নীতি হবে করোনায় মৃত্যু ও রোগের প্রকোপ কমানো।
জনস্বাস্থ্যবিদ আবু জামিল ফয়সাল বলেন, সরকার সবাইকে টিকা দিতে পারবে না। তবে টিকার বণ্টন যৌক্তিক হলে যাঁরা টিকা পাবেন না, তাঁদের মধ্যে বঞ্চনা বোধ কাজ করবে না। এ বিষয়ে ব্যাপকভিত্তিক আলোচনা হওয়া দরকার।

জাতীয় পরিকল্পনা চূড়ান্ত করার কাজ প্রায় শেষ। চূড়ান্ত হলে তা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে অনুমোদনের জন্য
অধ্যাপক মীরজাদী সেব্রিনা, অতিরিক্ত মহাপরিচালক, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর

টিকা সংগ্রহ
সরকার বলছে, দেশের মানুষকে বিনা মূল্যে করোনার টিকা দেওয়া হবে। বাংলাদেশ টিকা সংগ্রহ ও টিকা কেনার বিষয়ে সমান গুরুত্ব দিয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায় গড়ে ওঠা বৈশ্বিক কোভ্যাক্স উদ্যোগে যুক্ত হয়েছে বাংলাদেশ। পরিকল্পনায় বলা হয়েছে, কোভ্যাক্স উদ্যোগ থেকে দেশের ২০ শতাংশ মানুষ টিকা পাবে। প্রতি ডোজ টিকার জন্য বাংলাদেশ ১ দশমিক ৬ থেকে ২ মার্কিন ডলার (১৩৬ থেকে ১৭০ টাকা) ব্যয় করবে। এ জন্য মোট ব্যয় হবে ১৮ থেকে ২১ কোটি ডলার (১ হাজার ৫৩০ কোটি থেকে ১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা)। আর কোভ্যাক্স থেকে ৪০ শতাংশ মানুষের জন্য টিকা নিলে ব্যয় হবে ২৯ থেকে ৩৫ কোটি ডলার (২ হাজার ৪৬৫ কোটি থেকে ২ হাজার ৯৭৫ কোটি টাকা)।
এর বাইরে টিকা উৎপাদনকারী দেশ ও কোম্পানির কাছ থেকেও টিকা কেনার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। পরিকল্পনায় বলা হয়েছে, প্রতি ডোজ টিকার দাম পড়বে ৬ থেকে ১০ ডলার (৫১০–৮৫০ টাকা)। ২০ শতাংশ মানুষের জন্য সরকার টিকা কিনলে ব্যয় হবে ৪৫ থেকে ৭৩ কোটি মার্কিন ডলার (৩ হাজার ৮২৫ কোটি থেকে ৬ হাজার ২০৫ কোটি টাকা)।

বিতরণ পদ্ধতি
৯৪ পৃষ্ঠার খসড়া জাতীয় পরিকল্পনায় বলা হয়েছে, সারা দেশে মোট ৬ হাজার ৩০০টি স্থানে টিকা দেওয়া হবে। এসব স্থানের মধ্যে আছে ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, জেলা সদর ও মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, সিটি করপোরেশনের ওয়ার্ড কার্যালয় এবং ১০০ বিশেষ জায়গা।
এসব স্থানে মোট ১৯ হাজার ৪৬৯টি দল টিকা দেওয়ার কাজে যুক্ত থাকবে। প্রতিটি দলে ৬ জন সদস্য থাকবেন। প্রতিটি দল দৈনিক ১০০ থেকে ১৫০ জনকে টিকে দেবে। সরকারি ছুটির দিন ছাড়া প্রতিদিন সকাল নয়টা থেকে বেলা তিনটা পর্যন্ত টিকা দেওয়া হবে।
টিকা কেনা, সংরক্ষণ, সরবরাহ ও টিকা দেওয়ার কাজ তদারক করার জন্য বেশ কিছু কমিটি গঠনের কথা পরিকল্পনায় বলা হয়েছে। কেন্দ্রীয় পর্যায়ে আছে তিনটি কমিটি—কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন টাস্কফোর্স, বাংলাদেশ ওয়ার্কিং গ্রুপ অন ভ্যাকসিন ম্যানেজমেন্ট এবং প্রিপেয়ার্ডনেস অ্যান্ড ডেপ্লয়মেন্ট কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন কোর কমিটি। এ ছাড়া বিভাগ, জেলা, সিটি করপোরেশন ও উপজেলা পর্যায়ে দুটি করে কমিটি কাজ করবে বলে পরিকল্পনা করা হয়েছে।
দুটি চ্যালেঞ্জ
টিকা দেওয়া এবং টিকা সংরক্ষণের ক্ষেত্রে দুটি সমস্যার কথা বলেছেন সরকারি কর্মকর্তারা। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক মীরজাদী সেব্রিনা বলেন, সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচিতে মূলত শিশুদের টিকা দেওয়া হয়। এ কাজে দেশের স্বাস্থ্যকর্মীরা অভ্যস্ত ও দক্ষ। কিন্তু করোনার টিকা দেওয়া হবে বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার ও মূলত বয়স্ক জনগোষ্ঠীকে।
দ্বিতীয় সমস্যাটি এসেছে মূলত টিকা সংরক্ষণকে কেন্দ্র করে। প্রথমত একসঙ্গে বিপুল পরিমাণ টিকা রাখার মতো জায়গা সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচিতে নেই। সেই কারণে সরকারের অন্যান্য স্থাপনা ও বেসরকারি স্থাপনা ভাড়া করার কথা পরিকল্পনায় বলা আছে। অন্য সমস্যাটি তাপমাত্রাবিষয়ক। কিছু টিকা রাখার জন্য অতি নিম্ন তাপমাত্রার সংরক্ষণাগার দরকার। এমন সংরক্ষণাগার সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচিতে বা বেসরকারি পর্যায়ে নেই। সে ক্ষেত্রে সারা দেশের জন্য ১ হাজার ৯৫টি অতি নিম্ন তাপমাত্রা নিশ্চিতকারী ফ্রিজার কেনার প্রয়োজনীয়তার কথা পরিকল্পনা দলিলে বলা আছে।
জনস্বাস্থ্যবিদেরা বলছেন, সরকারকে টিকা সংগ্রহ বা কেনার ব্যাপারে সুবিবেচনার পরিচয় দিতে হবে। টিকার ব্যবহার পুরোটাই সরকারের হাতে থাকলে নকল টিকার আশঙ্কা কম থাকবে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক বে-নজির আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘কাদের টিকা দেওয়া হবে, কীভাবে টিকা দেওয়া হবে, এসব ব্যাপারে স্বচ্ছতা থাকতে হবে। টিকার কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দেয় কি না, সে বিষয়ে কঠোর নজরদারির ব্যবস্থা রাখতে হবে।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *