প্রতিষ্ঠার প্রথম কয়েক বছর জাতীয় মানবাধিকার কমিশনকে অন্তত চারটি কাজ করতে দেখা যেত। কমিশন ‘বন্দুকযুদ্ধ’, গুমের মতো ঘটনায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিত, তথ্যানুসন্ধান করত ও সংবাদমাধ্যমে বিবৃতি দিত। আর বছর শেষে রাষ্ট্রপতির কাছে এ ধরনের ঘটনার বিস্তারিত বিবরণসহ জমা দিত একটি প্রতিবেদন।

এটুকু কাজেও এখন ঢিলেঢালা ভাব। অভিযোগ উঠছে বন্দুকযুদ্ধ–গুম–হেফাজতে নির্যাতনের মতো মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা কমিশন পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে।

সবশেষ প্রতিবেদনে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন বলেছে, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কিছু সদস্যের বিরুদ্ধে বাড়াবাড়ির অভিযোগ সরকারের জন্য ‘কিছুটা ইমেজ সংকটের’ সৃষ্টি করছে। তবে সরকারের মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য সাফল্য আছে।

প্রতিবেদনগুলোয় বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম, হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যুর অভিযোগের বিস্তারিত বিবরণ নেই। মাদকবিরোধী অভিযানে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ বহু মানুষের প্রাণহানি প্রসঙ্গে কমিশন বলেছে, ‘মাদকবিরোধী অভিযানকালে বন্দুকযুদ্ধে অভিযুক্ত মাদক চোরাকারবারিদের মৃত্যুর ঘটনা এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের জখম হওয়ায় সারা দেশে তীব্র উদ্বেগের সৃষ্টি হয়।’ প্রতিবেদনে তারা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগকে ‘কথিত অভিযোগ’ বলেও উল্লেখ করে।

জাতীয় মানবাধিকার কমিশন এক দশক পার করে ১১ বছরে পা দিল এবার। কমিশনের ভূমিকা নিয়ে এর আগে ২০১৯ সালের ৩০–৩১ জুলাই জাতিসংঘের নির্যাতনবিরোধী কমিটির ৬৭তম অধিবেশনে কথা উঠেছিল। ওই একই বছর জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচিও (ইউএনডিপি) একটি মূল্যায়ন প্রতিবেদন প্রকাশ করে। চলতি বছর কমিশনের এক দশকের কাজের ওপর আলাদা একটি মূল্যায়ন করেছে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)। মোটের ওপর কমিশনের কাজের যে মূল্যায়ন, তা হতাশাব্যঞ্জক।

জাতিসংঘের নির্যাতনবিরোধী কমিটির মন্তব্য ছিল, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় কমিশন সীমিত ক্ষমতা বা ক্ষমতার সর্বোচ্চ ব্যবহার করছে না। আর ইউএনডিপি বলেছে, নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার রক্ষার কাজে বিশেষ করে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম, হেফাজতে মৃত্যু ও নির্যাতনের মতো অভিযোগ আমলে নেওয়ার ক্ষেত্রে কমিশন যথেষ্ট মনোযোগী নয়।

অন্যদিকে আইন ও সালিশ কেন্দ্র ‘এক দশক শেষে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন, বাংলাদেশ—কার্যকারিতা, বিদ্যমান সীমাবদ্ধতা ও সুযোগসমূহ’ প্রকাশনায় বলেছে, শুরুর দিকে বড় ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় কমিশনের চেয়ারপারসন সরেজমিন রামু, বাঁশখালী, সুন্দরগঞ্জ, রানা প্লাজাসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিভিন্ন স্থান পরিদর্শনে গেছেন এবং গণমাধ্যমে বিবৃতি দিয়েছেন। সে সময় কমিশন অনেকটা ‘ওয়ান ম্যান শো’ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তারপরেও গণমাধ্যমে কমিশনের উপস্থিতি ছিল এবং বিভিন্ন মানবাধিকার ইস্যু বিষয়ে বক্তব্য পাওয়া যেত। পরবর্তী সময়ে তা কমতে শুরু করে এবং একপর্যায়ে কমিশনের উপস্থিতি আর সেভাবে লক্ষ করা যায়নি।
যদিও মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান নাছিমা বেগম বলেন, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন তার ম্যান্ডেট থেকে সরে আসেনি। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম, হেফাজতে নির্যাতনের মতো ঘটনার ক্ষেত্রে সক্রিয়তা কমে যাওয়ার কারণ কী, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আইনে স্পষ্টভাবে বলা আছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্তের এখতিয়ার কমিশনের নেই। আর মানবাধিকার লঙ্ঘন মানে শুধু এসব অধিকারের লঙ্ঘন নয়। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম ইত্যাদি অন্যতম হলেও, আরও অনেকভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *