২০১৬ সালের ৪ ডিসেম্বর রাতে (সেদিন ছিল বৃহস্পতিবার) বাংলাদেশ ব্যাংকে রিজার্ভ চুরি করতে সাইবার হামলা চালায় হ্যাকাররা। ওই ঘটনায় নিউইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার লাপাত্তা হয়ে যায়। ৬ ডিসেম্বর বা সেই সপ্তাহের শেষ ভাগে এসে বাংলাদেশ ব্যাংক টাকা খোয়া গেছে বুঝতে পারে। গতকাল সোমবার বিবিসি অনলাইনের এক প্রতিবেদনে এ ঘটনার বিস্তারিত তথ্য উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, ঘটনার একদিন পরই বাংলাদেশ ব্যাংক বিষয়টি আঁচ করতে পারে তবে তারা ঠিক বুঝে উঠতে পারছিল না, ঠিক কী হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন গভর্নর আতিউর রহমান যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ রাকেশ আস্তানাকে চিনতেন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি সহায়তার জন্য রাকেশকে ডেকে পাঠান। তখন রাকেশ বলেন, গভর্নর মনে করেছিলেন যে খোয়া যাওয়া টাকা ফেরত আনতে পারবেন তিনি। সে জন্য ঘটনাটি তিনি প্রকাশ করেননি। শুধু গণমাধ্যম নয়, সরকারকেও জানাননি তিনি।
এই সময় রাকেশ আস্তানা ঘটনার কূলকিনারা খুঁজতে গিয়ে দেখেন, এর শিকড় কতটা গভীরে। তিনি দেখলেন, হ্যাকাররা বাংলাদেশ ব্যাংকের সিস্টেমের গুরুত্বপূর্ণ অংশ সুইফটে ঢুকে পড়েছিলেন। সুইফটের মাধ্যমে বিশ্বের তাবৎ তাবৎ ব্যাংক নিজেদের মধ্যে বড় অঙ্কের অর্থ লেনদেন করে থাকে। সুইফটের দুর্বল জায়গা দিয়ে হ্যাকাররা ঢোকেননি। তাঁদের সেটা প্রয়োজনও ছিল না। কারণ, সুইফটের সফটওয়্যার মনে করেছিল, বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মীরা এই অর্থ স্থানান্তরের নির্দেশ দিয়েছেন। বাংলাদেশ ব্যাংক শিগগিরই বুঝে যায়, এই টাকা ফেরত আনা যাবে না। টাকার একটি অংশ ততক্ষণে ফিলিপাইনে চলে গেছে। সেখানকার কর্তৃপক্ষ জানায়, আদালতের আদেশ ছাড়া তাদের পক্ষে কিছু করা সম্ভব নয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি দল এই ঘটনায় ফিলিপাইনে যায়। এই ঘটনা বাংলাদেশের গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়ে গেলে গভর্নর আতিউর রহমান পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।
বাংলাদেশ ব্যাংক যত দিনে নড়েচড়ে বসতে শুরু করে, তত দিনে হ্যাকাররা ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যান।
ম্যানিলায় যা হয়
২০১৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি ফিলিপাইনের ম্যানিলার জুপিটার স্ট্রিটের আরসিবিসির ( রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং করপোরেশন )একটি শাখার চার হিসাব হঠাৎ করে সক্রিয় হয়ে ওঠে। ওই হিসাব চারটি ২০১৫ সালে খোলা হয়। এই টাকা এক হিসাব থেকে আরেক হিসাবে স্থানান্তর করা হয়। এরপর তা কারেন্সি এক্সচেঞ্জ ফার্মে স্থানীয় মুদ্রায় রূপান্তরিত হয়ে আবার আরসিবিসির সেই হিসাবে চলে আসে। এর একটি অংশ নগদ উত্তোলন করা হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়াভিত্তিক ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম ম্যানেজমেন্ট প্রোগ্রামের পরিচালক মোয়ারা রুয়েসেন বিবিসিকে বলেন, ‘অপরাধের মাধ্যমে আহরিত অর্থের শরীর থেকে কেলেঙ্কারির গন্ধ দূর করতে এমন কিছু করতে হয় যাতে মনে হয়, এই টাকা বৈধ উৎস থেকে এসেছে। এই টাকা ব্যবহার করতে এটা করতে হবে। এ ছাড়া অপরাধীরা টাকার উৎস যতটা সম্ভব অজ্ঞাত রাখতে চায়।’
তা সত্ত্বেও তদন্তকারীরা টাকার উৎস বের করতে পারেন। একদম নিশানা না রাখতে চাইলে ব্যাংকিং ব্যবস্থা এড়াতে হবে। ফিলিপাইনের রাজধানী ম্যানিলার একটি প্রাসাদোপম ভবনে গড়ে তোলা হয়েছে দ্য সোলেয়ার ক্যাসিনো। এ ছাড়া ওই ভবনে রয়েছে হোটেল, অভিজাত দোকান, থিয়েটার ইত্যাদি। বিশাল ক্যাসিনোটি জুয়াড়িদের জন্য আকর্ষণীয় জায়গা। ইনসাইড এশিয়ান গেমিং ম্যাগাজিনের এডিটর-অ্যাট-লার্জ মোহাম্মেদ কোহেন বলেন, ‘এটি এশিয়ায় সবচেয়ে মার্জিত ও রুচিশীল ক্যাসিনোগুলোর একটি। খুব নান্দনিক নকশায় তৈরি করা হয়েছে এই ক্যাসিনো। এতে জুয়া খেলার ৪০০টি টেবিল ও ২ হাজার মেশিন বা যন্ত্র রয়েছে।’
নিউইয়র্ক ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে রাখা বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ফিলিপাইনের আরসিবিসি ব্যাংকের মাধ্যমে যে ৮ কোটি ১০ লাখ মার্কিন ডলার হ্যাকাররা হাতিয়ে নেন, সেগুলোর মধ্যে পাঁচ কোটি ডলার চলে যায় এই জমকালো সোলেয়ার ক্যাসিনো ও মাইডাস ক্যাসিনোর হিসাবে। ফিলিপাইনের সিনেট কমিটির তদন্ত অনুযায়ী বাকি ৩ কোটি ১০ লাখ ডলার দেওয়া হয় জু উইক্যাং নামের এক চীনা নাগরিককে। ওই লোক একটি প্রাইভেট জেট বা ব্যক্তিগত বিমানে চড়ে দ্রুতই ম্যানিলা থেকে সটকে পড়েন। এরপর তাঁর আর হদিস পাওয়া যায়নি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের চুরি হওয়া রিজার্ভের অর্থের যাতে কোনোভাবেই খোঁজ না পাওয়া যায়, সে জন্যই মূলত তা ক্যাসিনোতে নেওয়া হয়। সেখানে জুয়ার টেবিল হয়ে নগদ অর্থ হাতবদল হয়ে কোথায় কার কাছে গেছে, তা তদন্তকারীদের পক্ষে খুঁজে বের করা একেবারেই অসম্ভব। এভাবে রিজার্ভ সরিয়ে নেওয়াটা হ্যাকার বা চোরদের জন্য কোনো রকম ঝুঁকিপূর্ণ বা ডলার খোয়া যাওয়ার ভয় ছিল না। কারণ, হ্যাকাররা গণরুমে না গিয়ে প্রাইভেট রুম ভাড়া নিয়ে নিজেরা নিজেরাই মিলে সাজানো জুয়া খেলে অর্থ সরিয়ে নেয়। অপরাধীরা কয়েক সপ্তাহ ধরে ম্যানিলার ক্যাসিনোতে বাক্কারাত নামের একটি সহজ, জনপ্রিয় ও কম ঝুঁকিপূর্ণ জুয়া খেলে চুরির অর্থ সরিয়ে নেয়।
চুরি যাওয়া অর্থ উদ্ধারের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা ম্যানিলা সফর করেন। কিন্তু ওই অর্থ ক্যাসিনোতে চলে যাওয়ার কারণে কর্মকর্তারা আর কোনো কূলকিনারা করতে পারেননি। তা ছাড়া তখন ফিলিপাইনের মানি লন্ডারিং বা অর্থ পাচার আইনে ক্যাসিনো বা জুয়া খেলার জায়গাগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার বিধান ছিল না। ফলে অপরাধীরা সহজেই পার পেয়ে যায়। ক্যাসিনোতে জুয়া খেলার নিয়ম হলো, বাজিতে জিতে যে কেউই জুয়ার বোর্ড থেকে নগদ অর্থ নিয়ে চলে যেতে পারে। এ সুবিধাই কাজে লাগিয়েছেন হকাররা। সোলেয়ার ক্যাসিনোর কর্তাব্যক্তিরাও বলে দিলেন, চুরির অর্থে জুয়া খেলা সংঘটিত হচ্ছিল এমন তথ্য তাঁদের জানা ছিল না। আর এ সম্পর্কে মাইডাস ক্যাসিনো কর্তৃপক্ষ কোনো কথা বলতে রাজি হয়নি।
তবে ব্যাংক কর্মকর্তারা অবশ্য ক্যাসিনোতে যাওয়া অর্থের মধ্যে ১ কোটি ৬০ লাখ ডলার উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছেন। কিম ওং নামের এক জুয়া আয়োজনকারীর কাছ থেকে ওই অর্থ উদ্ধার করা হয়। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হলেও পরে তা বাতিল করা হয়। বাকি ৩ কোটি ৪০ লাখ ডলার সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। তদন্তকারীরা মনে করেন, ওই অর্থ উত্তর কোরিয়ায় চলে গেছে।
চীনের ছিটমহল ম্যাকাও বিশ্বের সবচেয়ে নামীদামি ক্যাসিনোর শহর। এটিও জুয়াড়িদের খুব পছন্দের জায়গা। উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে ম্যাকাওয়ের সংযোগ রয়েছে। উত্তর কোরিয়ায় ২০২০ সালের গোড়ার দিকে অত্যন্ত উঁচু মানের ১০০ মার্কিন ডলারের নকল নোট ধরা পড়ে। এ ধরনের ডলারকে ‘সুপার ডলার’ বলা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের দাবি, ওই সব ডলার উত্তর কোরিয়াতেই ছাপা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের চুরি যাওয়া রিজার্ভ ফিলিপাইন হয়ে ম্যাকাওয়ে পাচার হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। কারণ, ম্যানিলায় যারা জুয়ার আয়োজন করেছিল, তাদের মধ্যে কয়েকজনের সেখান থেকে ম্যাকাওয়ে ফিরে যাওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। আর সোলেয়ার ক্যাসিনোতে প্রাইভেট গ্যাম্বলিং রুম বা আলাদা রুম বুক করে জুয়ার আয়োজনকারী দুই প্রতিষ্ঠান হচ্ছে ম্যাকাওয়ের। ফিলিপাইনের তদন্তকারীরা মনে করেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের চুরি হওয়া রিজার্ভের অর্থ চূড়ান্তভাবে উত্তর কোরিয়ায় স্থানান্তরের আগে ম্যাকাওয়ে নেওয়া হয়েছিল। আর উত্তর কোরিয়া হলো বিশ্বের সবচেয়ে আধুনিক ও বেহায়া কিসিমের হ্যাকার তৈরির উর্বর ক্ষেত্র। মার্কিন কর্তৃপক্ষ মনে করে, দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি ও পারমাণবিক কর্মসূচিতে অর্থায়নের জন্য উত্তর কোরিয়া নকল ডলার তৈরি করাসহ নানা রকমের অবৈধ পদ্ধতির আশ্রয় নিয়ে থাকে।