অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় পরিবারের সদস্যদের নিয়োগ দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য শহীদুর রহমান খানের বিরুদ্ধে। তিনি নিজের ছেলেকে অ্যাডহক ভিত্তিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা কর্মকর্তা বা সেকশন অফিসার হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন। মেয়েকে নিয়োগ দিয়েছেন শিক্ষক হিসেবে। অধ্যাপক পদে তাঁর স্ত্রীও এই বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ পেতে আবেদন করেছেন। তবে এ নিয়োগের প্রক্রিয়া স্থগিত করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

শুধু উপাচার্যের পরিবারের সদস্য নয়, নতুন প্রতিষ্ঠিত এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য নিয়োগ নিয়েও অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। বিশ্ববিদ্যালয়টির নীতিনির্ধারণী ফোরাম সিন্ডিকেটের পাঁচজন সদস্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়ে এসব অভিযোগ খতিয়ে দেখার আবেদন জানিয়েছেন।

চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা পেয়ে তদন্ত শুরু করেছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) তিন সদস্যের একটি কমিটি। কমিটির আহ্বায়ক ইউজিসির সদস্য বিশ্বজিৎ চন্দ বলেন, তথ্য সংগ্রহের কাছ চলছে। তাঁরা প্রকৃত সত্য উদ্‌ঘাটন করে প্রতিবেদন দেওয়ার চেষ্টা করছেন।

শুরুতেই অনিয়ম

২০১৫ সালে জাতীয় সংসদে খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় আইন পাস হয়। এরপর ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে উপাচার্য হিসেবে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক শহীদুর রহমান খানকে নিয়োগের মধ্য দিয়ে মূলত বিশ্ববিদ্যালয়টির কার্যক্রম শুরু হয়।

বিশ্ববিদ্যালয়টির রেজিস্ট্রার কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, সেখানে বর্তমানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২২১। এ পর্যন্ত ৭৫ জন শিক্ষক, ২৩ জন কর্মকর্তা, ৭৪ জন কর্মচারীসহ মোট ১৭২ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তবে মোট অনুমোদিত পদ ৪৩৩টি। খালি পদে ধাপে ধাপে নিয়োগ কার্যক্রম চলছে।

নিয়োগে অনিয়ম নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টির পাঁচ সিন্ডিকেট সদস্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেন গত ২৪ নভেম্বর। অভিযোগকারীরা হলেন বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের নির্বাহী চেয়ারম্যান, গাজীপুরে অবস্থিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক এবং বাংলাদেশ ইক্ষু গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক (তৎকালীন)। বিশ্ববিদ্যালয়টিতে সিন্ডিকেটের মোট সদস্য ২৫ জন।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে দেওয়া চিঠিতে পাঁচ সিন্ডিকেট সদস্য উল্লেখ করেন, শুরু থেকেই খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগে অস্বচ্ছতা ও আত্মীয়করণের অভিযোগ রয়েছে। এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মো. গিয়াসউদ্দিন মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, তদন্ত চলাকালে তিনি এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে চান না।

ছেলে-মেয়েকে নিয়োগ

পাঁচ সিন্ডিকেট সদস্যের দেওয়া লিখিত অভিযোগে বলা হয়, নিয়োগপ্রক্রিয়া অনুসরণ না করে অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় বেশ কিছুসংখ্যক কর্মকর্তা-কর্মচারীকে অ্যাডহক ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, যেখানে উপাচার্যের ছেলে মো. শফিউর রহমান খানও রয়েছেন। উপাচার্যের মেয়ে ইসরাত খানকে সম্প্রতি অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়টির কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

সিন্ডিকেটের একটি সূত্র জানিয়েছে, কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ সংশ্লিষ্ট অনুষদের ডিন ও বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্বে রয়েছেন উপাচার্য নিজেই। তাঁর মেয়ে ইসরাত খানকে নিয়োগের প্রক্রিয়ায় যে দুজন শিক্ষককে বাছাই কমিটিতে আমন্ত্রিত সদস্য হিসেবে রাখা হয়, তাঁদের একজন উপাচার্যের ঘনিষ্ঠ। অন্যজন উপাচার্যের মেয়ের স্নাতকোত্তরে সুপারভাইজার ছিলেন।

উপাচার্যের মেয়ে ইসরাত খানের নিয়োগের পথ পরিষ্কার করতেই এই দুই শিক্ষককে বাছাই কমিটিতে রাখা হয় বলে একাধিক সিন্ডিকেট সদস্যের অভিযোগ। বাছাই কমিটিতে নির্বাচিত ব্যক্তি ছাড়া এ দুই সদস্যের অংশগ্রহণ নিয়ে ক্ষোভও প্রকাশ করেন তাঁরা।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে দেওয়া পাঁচ সিন্ডিকেট সদস্যের চিঠিতে এ বিষয়ে বলা হয়, শিক্ষক হিসেবে নির্বাচিত প্রার্থীদের তালিকা ও তথ্যাদি সিন্ডিকেট সভায় উপস্থাপন করার কথা থাকলেও তা হয়নি। এ নিয়ে দ্বিতীয় সিন্ডিকেট সভায় (গত বছরের ১৫ মার্চ) সদস্যরা ক্ষোভ প্রকাশ করেন। এরপর তৃতীয় সিন্ডিকেট সভায়ও (গত ২০ নভেম্বর) তালিকা তুলে ধরা হয়নি। এমনকি তৃতীয় সভায় এর আগের সভার কার্যবিবরণীও পেশ করা হয়নি।

চিঠিতে আরও বলা হয়, তৃতীয় সিন্ডিকেট সভায় একজন সদস্য কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষক নিয়োগে বাছাই বোর্ডের সদস্য না হয়ে আমন্ত্রিত সদস্য হিসেবে উপস্থিত থেকে মৌখিক পরীক্ষা নেওয়া নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তখন বিষয়টি যথাযথ হয়েছে কি না, তা যাচাইয়ের জন্য একটি কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। যদিও সম্প্রতি উপাচার্যের মেয়েকেই শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।

অধ্যাপক হতে চান উপাচার্যের স্ত্রী

উপাচার্যের স্ত্রী ফেরদৌসী বেগম প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরে চাকরি করেন। তিনি একটি উপজেলার প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা। জানা গেছে, তিনি বিশ্ববিদ্যালয়টির মাইক্রোবায়োলজি অ্যান্ড পাবলিক হেলথ বিভাগের অধ্যাপক পদে প্রার্থী হয়েছেন। তবে শিক্ষা মন্ত্রণালয় গত ৯ ডিসেম্বর এই বিভাগসহ বিভিন্ন নিয়োগ কার্যক্রম পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত স্থগিত করেছে।

এসব বিষয়ে উপাচার্য শহীদুর রহমান খান গত শনিবার মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, উপাচার্যের পরিবারের সদস্যরা সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরির জন্য আবেদন করতে পারবেন না, নিয়োগ পাবেন না, এমন কোনো নিয়ম নেই। স্ত্রীর আবেদনের বিষয়ে তিনি বলেন, তাঁর স্ত্রী জাপান থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছেন। যোগ্যতা থাকলে তিনিও নিয়োগ পাবেন। পাঁচ সিন্ডিকেট সদস্যের অভিযোগের বিষয়ে উপাচার্য বলেন, তাঁদের কোনো আপত্তি থাকলে সেটা সিন্ডিকেট সভায় উপস্থাপন করতে পারতেন। সেটা না করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছেন।

অবশ্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, যোগ্যতা থাকলে উপাচার্যের পরিবারের সদস্যদের নিয়োগ নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলবে না। কিন্তু নিয়োগ অস্বচ্ছ হতে পারবে না। পাঁচ সিন্ডিকেট সদস্য চিঠিতে বলেছেন, তাঁরা নিয়োগে অনিয়ম নিয়ে বিব্রতবোধ করছেন। নিয়োগে স্বচ্ছতা আনার জন্য একটি যথাযথ কমিটির মাধ্যমে পুরো বিষয়টি যাচাই হওয়া দরকার।

ইউজিসির সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল মান্নান বলেন, একজন উপাচার্য ও শিক্ষকের বিরুদ্ধে যখন এ ধরনের অনৈতিক অভিযোগ ওঠে, তখন শিক্ষক হিসেবে আহত হতে হয়। খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়টি নতুন। শুরু থেকেই সেখানে সবচেয়ে মেধাবীদের নিয়োগ দেওয়া উচিত। তিনি বলেন, দুর্ভাগ্যজনকভাবে বলতে হয়, শুধু এই বিশ্ববিদ্যালয়েই নয়, আরও একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগপ্রক্রিয়া স্বচ্ছ হয় না বলে অভিযোগ উঠছে। এসব অভিযোগ তদন্ত হওয়া উচিত এবং দোষী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। শিক্ষা আর দোকানদারি এক জিনিস নয়।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *