যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনী রাজনীতিতে ডেমোক্রেট-নিয়ন্ত্রিত অঙ্গরাজ্যগুলো ‘নীল’ এবং রিপাবলিকান-নিয়ন্ত্রিত রাজ্যগুলো ‘লাল’ হিসেবে পরিচিত। এই অঙ্গরাজ্যগুলো বছরের পর বছর একই দলকে ভোট দেওয়ায় প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীরা অনেক সময় সেসব রাজ্যে প্রচারণার কোনো প্রয়োজনই বোধ করেন না। তাঁদের সব মনোযোগ থাকে নীল বা লাল নয়, এমন মিশ্র রঙের রাজ্যগুলোর ওপর। ২০১৬ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্পের অপ্রত্যাশিত বিজয়ের মূল রহস্য ছিল হিলারি ক্লিনটনের ‘নীল দেয়াল’–এর পতন। তিনি ৩০ লাখ ভোট বেশি পেয়েও পরাজিত হয়েছিলেন পেনসিলভানিয়া, মিশিগান ও উইসকনসিন—এই তিন নীল রাজ্যে মাত্র ৭৭ হাজার ভোটের ব্যবধানে। ডেমোক্র্যাটদের ‘নীল প্রতিরক্ষাব্যূহ’ হিসেবে পরিচিত এই তিন রাজ্যে নিজের বিজয়ের ব্যাপারে এতটাই নিশ্চিত ছিলেন যে হিলারি এখানে নির্বাচনী প্রচারণার কোনো প্রয়োজনই দেখেননি।
২০২০ সালের নির্বাচনেও এই তিন রাজ্যে রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প ও তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী ডেমোক্রেটিক প্রার্থী জো বাইডেনের জন্য সমান গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। জিততে হলে উভয়কেই এই তিন রাজ্যের মোট ৪৬টি ইলেকটোরাল কলেজ ভোট পেতে হবে। এর মধ্যে একটি বা দুটি হারালেও বিজয়ের পথ উন্মূক্ত থাকবে, কিন্তু তার জন্য দলীয় নিয়ন্ত্রণের বাইরে অন্য কোনো অঙ্গরাজ্য থেকে সমপরিমাণ বা তার চেয়ে বেশি ইলেকটোরাল ভোট অর্জন করতে হবে। এ ব্যাপারে অধিক স্বস্তিজনক অবস্থানে রয়েছেন বাইডেন। জনসংখ্যাগত পরিবর্তনের ফলে জর্জিয়া, অ্যারিজোনা, নেভাদা, আইওয়া বা টেক্সাসের মতো লাল রাজ্য ক্রমশ রং বদলাচ্ছে, বিপুলসংখ্যক অশ্বেতকায় নাগরিকদের আগমনের ফলে তারা আর নির্ভরযোগ্য লাল রাজ্য নয়। ফলে হিলারির নীল দেয়ালে যদি ফাটল ধরে, ভিন্ন পথ ধরে ২৭০টি ইলেকটোরাল ভোট অর্জনের পথ বাইডেনের জন্য খোলা রয়েছে। ট্রাম্পের জন্য বিকল্প কোনো পথ নেই।
জাতীয় জনমত জরিপে বাইডেন ৮–১০ পয়েন্টে এগিয়ে থাকলেও এই মুহূর্তে তাঁর সব মনোযোগ হিলারির ‘নীল দেয়াল’ নিজের কবজায় রাখা। উইসকনসিন (৭ পয়েন্ট) ও মিশিগানে (৮ পয়েন্ট) বাইডেন লক্ষণীয় ব্যবধানে এগিয়ে রয়েছেন। বাকি রইল পেনসিলভানিয়া, সেখানেও তিনি বর্তমানে ৫-৬ পয়েন্টে এগিয়ে। কিন্তু মিশিগান বা উইসকনসিনের মতো ততটা পোক্ত নয় এই ব্যবধান। তেল-গ্যাসের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করে ও ফ্রাকিংয়ের (তেল–গ্যাস আহরণের একটি পদ্ধতি) বিরুদ্ধাচরণ করে তিনি এই রাজ্যের একাংশ ভোটারের সমর্থন হারাতে পারেন। সেই বিপদ থেকে তিনি বারবার এখানে ফিরে আসছেন, সাবেক প্রেসিডেন্ট ওবামাকেও পাঠিয়েছেন তাঁর হয়ে ওকালতি করতে। এই তিন রাজ্য নিয়ে ডেমোক্র্যাটদের উদ্বেগের একটি যুক্তিসংগত কারণ রয়েছে। ২০১৬ সালে হিলারি এই তিন রাজ্যেই গড়ে পাঁচ পয়েন্টে এগিয়ে থেকেও এক পয়েন্টের কম ব্যবধানে সেখানে পরাস্ত হন।
বাইডেন পেনসিলভানিয়ার স্ট্রানটনে জন্মগ্রহণ করেন, সে জন্য এই রাজ্যেই নিজের শিকড় হিসেবে পরিচয় দিতে ভালোবাসেন। এই রাজ্যের শ্রমিক ইউনিয়নের সঙ্গেও তাঁর সখ্য রয়েছে। তিনি নিম্নবিত্ত পিতার উদাহরণ দিয়ে নিজেকে শ্রমিকশ্রেণির একজন বলেই ভাবেন। এই রাজ্যে জয় তাঁর জন্য একটি ব্যক্তিগত চ্যালেঞ্জ।
ট্রাম্পও আশা নিয়ে বসে আছেন, ২০১৬ সালের সাফল্যের তিনি পুনরাবৃত্তি করবেন, যার শুরু হবে এই পেনসিলভানিয়া থেকে। গ্রামপ্রধান এই রাজ্যের স্বল্প শিক্ষিত শ্বেতকায়দের মধ্যে তাঁর ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ বা সর্বাগ্রে আমেরিকা স্লোগান অত্যন্ত জনপ্রিয়। তেল-গ্যাস–শিল্পনির্ভর এই রাজ্যে তাঁর অর্থনৈতিক কর্মসূচিও বেশ জনপ্রিয়। জরিপে পিছিয়ে থাকলেও চূড়ান্ত ভোটে যদি তিনি এই রাজ্য দখলে সক্ষম হন, তাহলে বিস্ময়ের কিছু থাকবে না। কিন্তু এখানে যদি তিনি হড়কে বসেন, তাহলে উঠে দাঁড়ানো তাঁর পক্ষে কঠিন হবে। অধিকাংশ বিশ্লেষকের ধারণা, ক্লিনটনের নীল দেয়াল হিসেবে পরিচিত যেকোনো একটি দখল ছাড়া ২৭০টি ইলেকটোরাল কলেজ ভোট অর্জন কঠিন হবে।
ট্রাম্পের জন্য আরেক মাথাব্যথা ফ্লোরিডা। ২০১৬ সালে তিনি এই রাজ্য পেয়েছিলেন, এবারও এই বৃহৎ রাজ্যে জয় না পেলে প্রয়োজনীয় ইলেকটোরাল ভোট অর্জন শুধু কঠিন নয়, কার্যত অসম্ভব হয়ে পড়বে।
ট্রাম্পের জন্য অন্য এক সমস্যা তহবিল নিয়ে। একসময় তাঁর তহবিলে বিলিয়ন ডলারের বেশি চাঁদা উঠেছিল, কিন্তু অনিয়ন্ত্রিত ব্যয়ের কারণে এখন তাঁর তহবিলে পর্যাপ্ত অর্থ নেই। তিনি এতটাই অর্থকষ্টে ভুগছেন যে তাঁর জন্য গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যগুলোতে টেলিভিশন বিজ্ঞাপন হ্রাস করতে বাধ্য হয়েছেন। এই রাজ্যগুলোর একটি হলো ফ্লোরিডা। অন্যদিকে বাইডেনের পকেটে ট্রাম্পের তুলনায় দ্বিগুণ তহবিল থাকায় তিনি ফ্লোরিডায় টিভি বিজ্ঞাপন বাবদ অর্থ বরাদ্দ বাড়িয়ে দিয়েছেন। এখানে তাঁকে সাহায্য করছেন নিউইয়র্কের সাবেক মেয়র মাইকেল ব্লুমবার্গ। তিনি শুধু এই রাজ্যেই ১০০ মিলিয়ন ডলার ব্যয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
তবে মাঠপর্যায়ে সংগঠনের ক্ষেত্রে বাইডেনের তুলনায় ট্রাম্প শিবির অধিক মজবুত অবস্থায় রয়েছে। কোভিডের কারণে বাইডেন শিবির মুখ্যত অনলাইন প্রচারণার ওপর জোর দিচ্ছে। অন্যদিকে ট্রাম্প প্রথমাবধি ঘরে ঘরে গিয়ে ভোটারদের কাছে ধরনা দেওয়ার কাজ চালিয়ে গেছেন। নতুন ভোটার তালিকাভুক্তির ব্যাপারেও ট্রাম্প শিবির এগিয়ে। রিপাবলিকানদের আশা, ডাক-ভোটের ব্যাপারে পিছিয়ে থাকলেও সশরীরে ভোট প্রদানে তাঁরা এগিয়ে থাকবেন।