২০১৫ সালের ১২ জানুয়ারি নগরের খুলশী থানার একটি হত্যা মামলায় তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী মাসুদ কামালের পরিবর্তে আদালতে আত্মসমর্পণ করেন হুমায়ূন কবির নামের এক ব্যক্তি। এ জন্য মাসুদ ও তাঁর মধ্যে ২৫ হাজার টাকার চুক্তি হয়। বলা হয়, কারাগারে যাওয়ার দু-এক দিন পর হুমায়ূন কবিরকে বের করে আনবেন। কিন্তু পাঁচ দিন পার হওয়ার পরও তাঁকে বের না করায় তিনি তৎকালীন চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের জ্যেষ্ঠ তত্ত্বাবধায়ক মো. ছগির মিয়াকে পুরো ঘটনা খুলে বলেন। পরে বিষয়টি আদালতকে জানানো হয়। আদালতের নির্দেশে ওই মামলা থেকে হুমায়ূনকে মুক্তি দেওয়া হয়। পরে দুজনের বিরুদ্ধে প্রতারণা মামলা হয়।
নগরের কোতোয়ালি থানার একটি হত্যা মামলায় যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামি কুলসুমা আক্তারের পরিবর্তে ২০১৮ সালের ৯ জুলাই কারাগারে যান মিনু আক্তার। মর্জিনা আক্তার নামের পূর্বপরিচিত এক নারী তাঁকে টাকা দেওয়ার কথা বলে কারাগারে যেতে বলেন। তিনি কুলসুমাকে চেনেন না। ভয়ে এত দিন কাউকে কিছু বলেননি। গত ২২ মার্চ বিষয়টি জানাজানি হয়। ১৬ জুন তিন বছর কারাভোগ করে মুক্তি পান মিনু। পলাতক রয়েছেন প্রকৃত আসামি কুলসুম।
আরেকটি ঘটনা গত বছরের। পাওনা টাকা নিয়ে প্রতারণার মামলায় আনোয়ারার মোজাম্মেল হক নামের এক ব্যক্তিকে ছয় মাসের সাজা দেন আদালত। গত বছরের ১৬ ফেব্রুয়ারি মোজাম্মেল তাঁর পরিবর্তে দিদারুল আলম নামের এক ব্যক্তিকে ১০ হাজার টাকার বিনিময়ে আত্মসমর্পণ করান। আদালত তাঁকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দিলে কাঠগড়ায় থাকা দিদার কান্না করতে থাকেন। বলতে থাকেন, ‘স্যার আমি দিদার, মোজাম্মেল নই।’ পরে আদালতের বেঞ্চ সহকারী বাদী হয়ে মামলা করেন। ওই মামলায় দুজনকে কারাগারে পাঠানো হয়।
একজনের হয়ে আরেকজনের কারাবাস চট্টগ্রামে নতুন ঘটনা নয়। নগরের চকবাজার থানার একটি মানব পাচার মামলায় হোটেলমালিক মো. আজাদ সেজে টাকার বিনিময়ে চুক্তিতে গত বছরের ৩ সেপ্টেম্বর কারাগারে যান হোটেলের কর্মচারী আবদুর রহিম।
বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর ১৭ মার্চ পুলিশ প্রকৃত আসামি আজাদকে গ্রেপ্তার করে।
প্রতারণার অভিযোগে দুজনের বিরুদ্ধে আলাদা মামলা হয়। দুজনই এখন কারাগারে।
এভাবে চট্টগ্রামে কারামুক্ত থাকতে কিছু আসামি প্রতারণার আশ্রয় নিচ্ছেন। তাঁরা চুক্তিতে নিজের বদলে অন্য ব্যক্তিকে আসামি সাজিয়ে আদালতে আত্মসমর্পণ করাচ্ছেন। বিনিময়ে দিচ্ছেন টাকা। গত এক দশকে এমন ১৫টির বেশি ঘটনা ঘটেছে।
জালিয়াতি বন্ধের জন্য গত বছরের ১৮ মার্চ চট্টগ্রাম চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ ওসমান গণি আসামির আত্মসমর্পণের ক্ষেত্রে সত্যায়িত পরিচয়পত্র দেওয়ার নির্দেশ দেন। চট্টগ্রামে ৭৪টি আদালত রয়েছে। আদালত সূত্র জানায়, এসব আদালতে প্রতিদিন গড়ে সহস্রাধিক আসামি আত্মসমর্পণ করেন। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সত্যায়িত পরিচয়পত্র দেওয়া হয় না।
আইনজীবীরা বলছেন, প্রতারণা বন্ধে আত্মসমর্পণে সংশ্লিষ্ট আইনজীবীর সত্যায়ন করা আসামির জাতীয় পরিচয়পত্র, জন্মনিবন্ধন বা পাসপোর্টের ফটোকপি জমা দেওয়ার নির্দেশনা আছে। কিন্তু সব সময় তা মানা হয় না। এ কারণে জালিয়াতির ঘটনা ঘটে।
চট্টগ্রাম মহানগর সরকারি কৌঁসুলি মো. ফখরুদ্দিন চৌধুরী বলেন, আসামি আত্মসমর্পণের ক্ষেত্রে জালিয়াতির ঘটনা বেড়েছে। তাই মহানগর দায়রা জজ আদালতে আসামির সত্যায়িত পরিচয়পত্র লাগে। মক্কেলের উপকার করতে গিয়ে তাড়াহুড়োর মধ্যে কিছু আইনজীবী সরল বিশ্বাসে তা দেন না। এ সুযোগকে কাজে লাগায় কিছু আসামি। আসামির আত্মসমর্পণের ক্ষেত্রে সত্যায়িত পরিচয়পত্র যাতে দেওয়া হয়, সংশ্লিষ্ট কৌঁসুলিদের বলা আছে।
প্রতারণা বন্ধে সত্যায়িত জাতীয় পরিচয়পত্র আত্মসমর্পণের ক্ষেত্রে দেওয়া উচিত বলে মনে করেন অতিরিক্ত চট্টগ্রাম জেলা সরকারি কৌঁসুলি মো. লোকমান হোসেন চৌধুরী। তিনি বলেন, কিছু আদালতে তা মানা হলেও সবখানে যাতে হয়, আইনজীবীদের সতর্ক থাকা উচিত।
এ বিষয়ে ১০ জন আইনজীবীজানিয়েছেন, মামলার কাগজপত্র নিয়ে অনেক আসামি কিংবা তাঁদের স্বজন আসেন। ওই সময় তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় প্রকৃত আসামি কি না। পরিচয়পত্রও যাচাই-বাছাই করা হয়। কিন্তু অনেকে হারিয়ে গেছে কিংবা আগুনে পুড়ে গেছে নানা অজুহাত দেখিয়ে দিতে পারেন না। প্রতারণার সঙ্গে আইনজীবীদের সংশ্লিষ্টতা নেই।
কারাগারে যাওয়ার পর প্রত্যেক আসামির নাম-ঠিকানা, পরিবারের সদস্যসংখ্যা, শনাক্ত করার জন্য শরীরের বিশেষ দাগ রেজিস্ট্রারে লিপিবদ্ধ করা হয়। সঙ্গে তোলা হয় ছবি। একজনের পরিবর্তে আরেকজন যখন কারাগারে যান, তখন কেন ধরা পড়ে না জানতে চাইলে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের জ্যেষ্ঠ তত্ত্বাবধায়ক মো. শফিকুল ইসলাম খান বলেন, যাঁরা প্রতারণার আশ্রয় নেন, তাঁরা আগে থেকেই সব শিখে আসেন। এরপরও কারা কর্তৃপক্ষ ভুয়া বন্দীকে ধরেছে। আসামিরা জাতীয় পরিচয়পত্র সঙ্গে রাখলে সহজে তাঁদের শনাক্ত করা যায়।
কয়েকটি প্রতারণার ঘটনার কারণে আসামি আত্মসমর্পণের ক্ষেত্রে আইনজীবীদের আরও সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দেন চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি এনামুল হক। তিনি বলেন, অপরিচিত কেউ হলে জাতীয় পরিচয়পত্র দেখে জামিনের আবেদন করার জন্য আইনজীবীদের বলা হচ্ছে। এতে আসামিরা প্রতারণার সুযোগ পাবে না।