সংযোগ বিনা মূল্যে, মাসিক বিল মাত্র ১৫০ টাকা—এত সুবিধা দিয়েও গ্রাহক টানতে পারছে না সরকারি সংস্থার টেলিফোন সেবা। বছর বছর সংযোগ কমছে। যাঁদের ঘরে এখনো সংযোগ আছে, তাঁরাও টেলিফোন তেমন একটা ব্যবহার করেন না।
দেশে একসময় টেলিযোগাযোগের মাধ্যম বলতে ছিল বাংলাদেশ তার ও টেলিফোন বোর্ডের (বিটিটিবি) টেলিফোন সেবা, যা টিঅ্যান্ডটি নামে পরিচিত ছিল। তখন একটি সংযোগ পেতে মানুষকে নানা দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। অবশ্য এখন মানুষ মুঠোফোন বেশি ব্যবহার করছেন। ওদিকে করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো ইন্টারনেট সেবাদাতাদের কাছ থেকে ইন্টারনেটভিত্তিক টেলিফোন (আইপি) সেবা নিতেই বেশি আগ্রহী।
গ্রাহকসংখ্যা কমতে থাকার মধ্যে বিটিসিএল ২০১৯ সালের আগস্ট থেকে টেলিফোন থেকে টেলিফোনে কথা বলতে মাসে বিল সাকল্যে ১৫০ টাকা নির্ধারণ করে একটি ‘প্যাকেজ’ ঘোষণা করে। মুজিব বর্ষ উপলক্ষে টেলিফোন সংযোগ দেওয়া হয় বিনা মূল্যে।
কিন্তু এসব উদ্যোগ গ্রাহক বাড়াতে পারেনি। বরং কমেছে। বিটিটিবি থেকে ২০০৮ সালে বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন্স কোম্পানি লিমিটেডে (বিটিসিএল) পরিণত হওয়া এই সেবা প্রতিষ্ঠানটির টেলিফোন গ্রাহক দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ৮৪ হাজার ৩৯০টিতে। ২০১২-১৩ অর্থবছরেও বিটিসিএলের গ্রাহক ছিল ৯ লাখের কিছু বেশি।
বিটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রফিকুল মতিন প্রথম আলোকে বলেন, টেলিফোন সেবার মান বাড়াতে বিটিসিএল নানা উদ্যোগ নিয়েছে। সংযোগের জন্য আবেদন থেকে শুরু করে বিল দেওয়া পর্যন্ত পুরো কাজই এখন ডিজিটাল ব্যবস্থায় হচ্ছে। তবে প্রযুক্তির পরিবর্তন হওয়ার কারণে গ্রাহকের টেলিফোনে আগ্রহ কম। তিনি বলেন, এখন শুধু টেলিফোন সেবা দিয়ে চলা যাবে না। ব্যবসার পরিধি বাড়াতে হবে।
অবশ্য টেলিফোন ছাড়াও বিটিসিএল ইন্টারনেট গেটওয়ে বা আইজিডব্লিউ, কল আদান–প্রদান বা আইসিএক্স, গ্রাহক পর্যায়ে ইন্টারনেট, ডোমেইনসহ বিভিন্ন সেবা দেয়। যদিও সব মিলিয়ে তাদের রাজস্ব আয় কমছে। বছর বছর বড় অঙ্কের লোকসান দিচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি।
টেলিফোনটি ‘পড়েই থাকে’
রাজধানীর শেওড়াপাড়ার বাসিন্দা জাকিয়া আকতারদের বাসায় তিন দশক আগে টেলিফোন সংযোগ নেওয়া হয়। এখনো সংযোগ আছে। তবে ব্যবহার কম।
জাকিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘মায়ের সঙ্গে কথা বললে বা পরিচিত কারও বাসায় টেলিফোন থাকলে হয়তো কল করা হয়। তবে সেটাও খুবই কম। বলতে গেলে টেলিফোনটি পড়েই থাকে।’ তিনি আরও বলেন, ছোটবেলায় দেখতাম, প্রায়ই সংযোগ অচল থাকত। অভিযোগ জানালেও কাজ হতো না। মানুষ হয়তো প্রযুক্তির পরিবর্তনের পাশাপাশি বিরক্তির কারণেও টেলিফোন সংযোগ রাখেনি।
বিটিসিএল ২০১৯ সালের অক্টোবর থেকে তাদের টেলিসেবা অ্যাপের মাধ্যমে গ্রাহকদের অভিযোগ নেওয়া শুরু করেছে। অ্যাপে অভিযোগ জানালে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হয় বলে দাবি বিটিসিএলের। গ্রাহকেরাও বলছেন, তাঁরা টেলিসেবা অ্যাপে ভালো সেবা পেয়েছেন। অ্যান্ড্রয়েডভিত্তিক ফোনের অ্যাপ স্টোর গুগল প্লে স্টোরে অ্যাপটির মূল্যায়ন নম্বর বা রেটিং ভালো, ৫-এর মধ্যে ৪ দশমিক ২। সেখানে গ্রাহকদের ইতিবাচক মূল্যায়ন বা পজিটিভ রিভিউ বেশি। এ ছাড়া গ্রাহকের অভিযোগ জানতে তাদের কল সেন্টারও রয়েছে।
অবশ্য গ্রাহক বাড়াতে এসব উদ্যোগ ভূমিকা রাখতে পারেনি। মানুষের আগ্রহও বাড়াতে পারেনি। কারণ, তত দিনে হাতে হাতে মুঠোফোন এসে গেছে। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) হিসাবে, দেশে মুঠোফোন গ্রাহক দাঁড়িয়েছে ১৭ কোটির বেশি। ১৯৯৩ সালে দেশে মোবাইল ফোন সেবা চালু হয়। বিপরীতে কমতে থাকে টেলিফোন সেবা। এখন যাঁদের বাসায় টেলিফোন রয়েছে, তাঁরাও কথা বলেন মূলত মুঠোফোনে।
ঢাকার রাজারবাগের রাজিয়া হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘যদি কখনো লাগে, তাই টেলিফোন সংযোগটি রেখে দিয়েছি।’
এদিকে ইন্টারনেট টেলিফোন (আইপি) সেবাদাতারা বলছেন, করপোরেট পর্যায়ে তাঁদের গ্রাহক বাড়ছে। ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবাদাতাদের সংগঠন আইএসপিএবির সাধারণ সম্পাদক এমদাদুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ৪০ থেকে ৫০টি প্রতিষ্ঠান এখন ইন্টারনেটভিত্তিক টেলিফোন সেবা দেয়। খরচ কম হওয়ায় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যালয়ে এ সেবা বেশি নেওয়া হয়। তিনি বলেন, আইপি থেকে আইপিতে কথা বলতে কোনো খরচ নেই। আইপি থেকে মুঠোফোনে কথা বলতে প্রতি মিনিটে কলচার্জ ৪০ পয়সার মতো।
বিটিসিএল জানিয়েছে, মাসে ১৫০ টাকা বিলের আওতায় তাদের টেলিফোন থেকে টেলিফোনে কথা বলার সুযোগ ‘আনলিমিটেড’, মানে হলো যত কথাই হোক, বিল একই। তবে মুঠোফোনে কল করলে মিনিটে ব্যয় ৫২ পয়সা। এর ওপর ১৫ শতাংশ মূল্য সংযোজন কর (মূসক/ভ্যাট) রয়েছে। বিটিসিএলের টেলিফোন সংযোগ নিতে ঢাকায় ১ হাজার, বিভাগীয় শহরে ৬০০ এবং জেলা ও উপজেলায় ৩০০ টাকা করে জামানত দিতে হয়।