মিয়ানমারের জেনারেলরা তর্কে তর্কেই ছিলেন। তাঁরা জুতসই অজুহাত খুঁজছিলেন। গত বছরের নভেম্বরে মিয়ানমারের জান্তারা একটা মোক্ষম অজুহাত পেয়ে যান। এ ক্ষেত্রে সম্ভবত তাঁদের পথ দেখান যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।

ভাবছেন সেটা কী করে হয়? তবে চলুন, সূত্র মেলানো যাক।

যুক্তরাষ্ট্রে গত বছরের ৩ নভেম্বর প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনের রাতেই ট্রাম্প আজগুবি এক দাবি করে বসেন। তিনি ভোটে ব্যাপক কারচুপি-জালিয়াতির অভিযোগ তোলেন। তারপর ধারাবাহিকভাবে দিন-রাত একই কথা আওড়াতে থাকেন। তবে তিনি কখনো ভোটে কারচুপির অভিযোগের পক্ষে কোনো তথ্য-প্রমাণ হাজির করেননি। ট্রাম্পের দাবির মুখে একাধিক অঙ্গরাজ্যে ভোট পুনর্গণনা করা হয়। কিন্তু দেখা যায়, সব ঠিকঠাকই আছে। বরং কোথাও কোথাও ট্রাম্পের পরাজয়ের ব্যবধান বাড়ে।

ট্রাম্প তাঁর ভিত্তিহীন দাবি নিয়ে বিভিন্ন আদালতে যান। একের পর এক মামলা ঠুকতে থাকেন। যথারীতি সব মামলা খারিজ হয়। ট্রাম্প দমে না গিয়ে তাঁর মিথ্যা দাবির ওপর ভর করে নির্বাচনের ফল পাল্টে দিতে নানা ফন্দিফিকির করেন। চলে তাঁর কূটচালের খেলা। তবে ট্রাম্পের কোনো তৎপরতাই হালে পানি পাচ্ছিল না।

এবার ট্রাম্প মরণকামড় দেওয়ার পরিকল্পনা আঁটেন। শেষ চেষ্টা হিসেবে গত ৬ জানুয়ারি মার্কিন কংগ্রেসে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফলাফলের সত্যায়ন আটকানোর মিশন নেন তিনি। নির্বাচনের ফলাফল পাল্টে আরেক দফায় ক্ষমতায় থাকার লোভে বেপরোয়া ট্রাম্প পুরো যুক্তরাষ্ট্র থেকে তাঁর হাজারো উগ্র সমর্থককে ওয়াশিংটন ডিসিতে জড়ো করেন। কারচুপির নির্বাচনের মাধ্যমে তাঁর জয় কেড়ে নেওয়া ঠেকাতে তিনি তাঁর সমর্থকদের উসকানি দেন। কংগ্রেসের যৌথ অধিবেশন শুরু হলে ট্রাম্পের শত শত সমর্থক ক্যাপিটল ভবনে হামলে পড়েন। নজিরবিহীন হামলায় রক্তাক্ত হয় মার্কিন কংগ্রেস। প্রাণ যায় পাঁচজনের। এত কিছুর পরও ট্রাম্পের ভয়ংকর পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়। জো বাইডেনকেই জয়ী ঘোষণা করে কংগ্রেস।

ক্ষমতার জন্য ট্রাম্প মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছিলেন। ভোট কারচুপির কাল্পনিক গল্প ফেঁদে তিনি মার্কিন জনগণের ভোটের রায়কে অস্বীকার করে চরম অগণতান্ত্রিক পথ বেছে নিয়েছিলেন। ৬ জানুয়ারির ঘটনাকে কেউ কেউ ‘ক্যু’ প্রচেষ্টা হিসেবে অভিহিত করে থাকেন। তাঁদের একজন মার্কিন অধ্যাপক ও রাজনীতিক বিশ্লেষক রবার্ট রিক। তাঁর মতে, ট্রাম্পই এই ক্যু করতে চেয়েছিলেন।

ট্রাম্পের ‘ক্যু’ প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। তবে তিনি নির্বাচনে কারচুপির ভুয়া দাবি তুলে অভ্যুত্থান-প্রচেষ্টার মাধ্যমে বিশ্বে একটা ন্যক্কারজনক উদাহরণ সৃষ্টি করেন।

যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দিন কয়েকের মাথায় মিয়ানমারে সাধারণ নির্বাচন হয়। ৮ নভেম্বরের নির্বাচনের পরই স্পষ্ট হয়ে যায়, দেশটির গণতন্ত্রপন্থী নেত্রী অং সান সু চির ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) বড় জয় পেতে যাচ্ছে। আর নির্বাচনে ভরাডুবি হতে যাচ্ছে সেনাসমর্থিত ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির।

ব্যস, সেনাবাহিনী ও সেনাসমর্থিত ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি ‘ট্রাম্পিয়ান’ কৌশল নেয়। কী সেই কৌশল? তারা ট্রাম্পের অনুসরণে নির্বাচনের পর ভোটে কারচুপির ভিত্তিহীন অভিযোগ তোলে। কিন্তু সেই অভিযোগের পক্ষে তারা কোনো প্রমাণ হাজির করেনি।

বিবিসিসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হয়, মিয়ানমারে নভেম্বরের নির্বাচনে জালিয়াতির যে অভিযোগ সেনাবাহিনী তুলেছে, তার পক্ষে প্রমাণ নেই বললেই চলে।

দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষক সংস্থাগুলোও মিয়ানমারের এই নির্বাচনকে একটি ভালো ও সফল নির্বাচন হিসেবে অভিহিত করে।

যেমন: কার্টার সেন্টার, এশিয়ান নেটওয়ার্ক ফর ফ্রি ইলেকশনস, ইউরোপীয় ইউনিয়নের ইলেকশন অবজারভেশন মিশন পৃথকভাবে মিয়ানমারের নির্বাচন সম্পর্কে ইতিবাচক মূল্যায়ন দেয়।

কার্টার সেন্টার জানায়, তারা প্রায় সব ভোটকেন্দ্র পরিদর্শন করে। তারা ভোট গ্রহণ ও গণনার প্রক্রিয়া নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করে। তারা ৮ নভেম্বরের নির্বাচনকে সফল হিসেবে বর্ণনা করে।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের ইলেকশন অবজারভেশন মিশন বলে, তাদের ৯৫ শতাংশ পর্যবেক্ষক নির্বাচনপ্রক্রিয়াকে ‘ভালো’ বা ‘খুব ভালো’ হিসেবে মূল্যায়ন করেছে।

দেশীয় পর্যবেক্ষক সংস্থা পিপলস অ্যালায়েন্স ফর ক্রেডিবল ইলেকশনস ও চ্যারিটি-ওরিয়েন্টেড মিয়ানমার এই নির্বাচন স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ হয়েছে বলে তার প্রশংসা করে।

নির্বাচনের ফলাফল বের হলে দেখা যায়, এনএলডি ৮৩ শতাংশ ভোট পেয়ে পার্লামেন্টের ৪৭৬টি আসনের মধ্যে ৩৯৬টিতে জয় পেয়েছে। অন্যদিকে, সেনাসমর্থিত ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি পেয়েছে মাত্র ৩৩টি।

ফল প্রকাশের পর সেনাবাহিনীর নড়চড় আরও বেড়ে যায়। ভোটে অনিয়ম-কারচুপি-জালিয়াতির অভিযোগ তদন্ত না করলে তারা অভ্যুত্থানের হুমকি দেয়। তখনই বোঝা গিয়েছিল, মিয়ানমারের জান্তার মতলব ভালো নয়। তারা ক্ষমতা দখলের পাঁয়তারা করছে।

নির্বাচন নিয়ে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও সেনাসমর্থিত রাজনৈতিক দলের ভুয়া অভিযোগ সম্প্রতি নাকচ করে দেশটির নির্বাচন কমিশন। ১ ফেব্রুয়ারি মিয়ানমারের নতুন পার্লামেন্টের প্রথম অধিবেশন বসার কথা ছিল। কিন্তু তা আর হয়নি। ওই দিন ভোরেই অভ্যুত্থান ঘটায় দেশটির সেনাবাহিনী। জনগণের ভোটে নির্বাচিত সু চির গণতান্ত্রিক সরকার উৎখাত করে ফের মিয়ানমারের ক্ষমতা দখল করে নেয় মিন অং হ্লাইংয়ের নেতৃত্বাধীন সেনাবাহিনী।

মিয়ানমারের সামরিক জান্তার এবারের ক্ষমতা দখল সম্পর্কে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া অঞ্চলের উপপরিচালক ফিল রবার্টসনের পর্যবেক্ষণ হলো নির্বাচনী জালিয়াতির যে অভিযোগ উঠেছে, তা কিছুটা ট্রাম্পিয়ান। কারণ, জালিয়াতির সব অভিযোগই প্রমাণহীন।

যুক্তরাষ্ট্রের অনলাইন সংবাদমাধ্যম বিজনেস ইনসাইডার এক প্রতিবেদনে ঠিক একই প্রসঙ্গ তুলেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, নির্বাচনের ফল পাল্টে ক্ষমতায় থাকতে ট্রাম্প ভোট জালিয়াতির ভিত্তিহীন অভিযোগ তুলেছিলেন। ক্ষমতা দখলের জন্য ট্রাম্পের মতো একই অজুহাত বেছে নেন মিয়ানমারের জেনারেলরা।

মিয়ানমার যে একটি ‘ক্যু-প্রবণ’ দেশ, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু এই বাস্তবতা সত্ত্বেও ট্রাম্পের সঙ্গে মিয়ানমারের জেনারেলদের নেওয়া কৌশলের মিল থাকার বিষয়টিকে পুরোপুরি নাকচ করার উপায় নেই।

এই সম্ভাবনার প্রসঙ্গে ইউনিভার্সিটি কলেজ অব লন্ডনের রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ব্রায়ান ক্লাসের মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তিনি বিজনেস ইনসাইডার সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, মার্কিন নির্বাচনের পরে ট্রাম্পের ব্যাপক ভোট জালিয়াতির মিথ্যা অভিযোগ দেখে মিয়ানমারের জেনারেলরা তাঁদের পরিকল্পনামাফিক ক্ষমতা দখলের অজুহাত হিসেবে একই পন্থা ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকলে অবাক হওয়ার কিছু নেই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *