বর্তমান বাস্তবতায় সবার কাছেই ইন্টারনেট সুবিধা পৌঁছে দিতে হবে। কিন্তু পর্যাপ্ত সুরক্ষার ব্যবস্থা না থাকায় শিক্ষার্থীরা বিশেষ করে শিশু-কিশোরেরা নানা রকমের ঝুঁকিতে পড়ছে। তাই ছাত্র, শিক্ষক, অভিভাবকসহ সবার জন্য সুরক্ষিত ইন্টারনেট ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
গতকাল মঙ্গলবার ইউনিসেফের উদ্যোগে আয়োজিত ‘ছাত্র-শিক্ষক ও অভিভাবকের অনলাইন নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ: চ্যালেঞ্জ ও করণীয়’ শীর্ষক ভার্চ্যুয়াল সংলাপে যুক্ত হয়ে এসব কথা বলেন সরকারি–বেসরকারি বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যক্তিরা।

ভার্চ্যুয়াল সংলাপে প্রধান অতিথি ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেন, নতুন প্রজন্ম নিরাপদ না থাকলে দেশ নিরাপদ হবে না, ভবিষ্যৎও নিরাপদ হবে না। এ জন্য সরকারের পক্ষ থেকে যা করার তাই করা হবে। তিনি বলেন, সুরক্ষিত ইন্টারনেট ব্যবস্থার বিষয়টি পাঠ্যপুস্তকে থাকতেই হবে। কিন্তু যিনি পড়াবেন, তিনি যদি না জানেন, তাহলে সেটি কাজে আসবে না। তাই শিক্ষকদেরও উপযুক্ত করে তুলতে হবে।
মন্ত্রীর বক্তব্যের আগে বক্তব্য দিতে গিয়ে কিছু দাবি তুলে ধরেন আন্তর্জাতিক শিশু শান্তি পুরস্কার বিজয়ী ও সাইবার টিনস অ্যাপের প্রতিষ্ঠাতা নড়াইলের কিশোর সাদাত রহমান। তিনি সাইবার বুলিং বিষয়টি সংজ্ঞাসহ সুনির্দিষ্টভাবে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানান। একই সঙ্গে ২০২১ সালের মধ্যে শিশুদের জন্য নিরাপদ ইন্টারনেট ব্যবস্থা নিশ্চিতের দাবি জানান।
সাদাতের বক্তৃতার মধ্যেই এই দাবি পূরণের আশ্বাস দেন ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী। তিনি বলেন, পরবর্তী সময়ে যখন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সংশোধন করা হবে, তখন এ বিষয়টি দেখা হবে। এ ছাড়া ২০২১ সালের মধ্যে যেন সব শিশুর জন্য নিরাপদ ইন্টারনেট হয়, সে জন্য সবাইকে কাজ করতে হবে। সরকারও এ জন্য প্রস্তুত আছে। শিক্ষা প্রশাসনের পক্ষ থেকে মতামত তুলে ধরেন মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) মহাপরিচালক সৈয়দ গোলাম ফারুক। তিনি বলেন, অবশ্যই এ বিষয়টি পাঠ্যপুস্তকে যোগ করা দরকার। করোনাকালে অনলাইন শিক্ষার পরিধি বাড়াতে হয়েছে। অভিভাবকেরা আগে সন্তানদের এসব ডিভাইস ব্যবহার করতে দিতেন না। এখন বাধ্য হয়ে দিচ্ছেন। শিশুদের অনলাইন ব্যবহারে ঝুঁকি আছে। তাই এটি পাঠ্যপুস্তকে আসুক বা না আসুক, এ বিষয়ে কাজ করতেই হবে এবং সেটা তাঁরা শুরু করে দিয়েছেন।
গ্রামীণফোনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ইয়াসির আজমান বলেন, সবার জন্য অনলাইন সুযোগ থাকতে হবে। কিন্তু প্রতিটি শিশুর অধিকার আছে কীভাবে তারা সুরক্ষিত থাকবে।
শিশুদের বিভিন্ন ঝুঁকির কথা তুলে ধরে সুরক্ষার ওপর গুরুত্বারোপ করেন ইউনিসেফের প্রতিনিধি টমো হাজুমি।
বাংলা মাধ্যম, ইংরেজি মাধ্যম ও মাদ্রাসা মিলিয়ে ১ হাজার ৪৮১ জন শিক্ষার্থীর ইউনিসেফের করা জরিপের তথ্য অনুষ্ঠানে তুলে ধরেন ইউনিসেফ বাংলাদেশের শিশু সুরক্ষা বিশেষজ্ঞ শাবনাজ জেহরিন। তিনি বলেন, জরিপে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ৪০ শতাংশ ছেলে ও ২৪ শতাংশ মেয়ে অহরহ সাইবার বুলিংয়ের শিকার হয়েছে। ১৯ শতাংশ শিশু এমন লেখা পেয়েছে, যা তাদের জন্য উপযোগী নয়। কেউ কেউ ছবিও আদান-প্রদান করেছে।
জরিপে দেখা যায়, ৫৭ শতাংশ শিশু বিভিন্ন অপরিচিত মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব করেছে। ১৪ শতাংশ শিক্ষার্থী এসব অপরিচিত মানুষের সঙ্গে দেখাও করেছে, যা উদ্বেগজনক। ১১ শতাংশ শিশু ব্যক্তিগত তথ্য আদান-প্রদানও করেছে। এই সংখ্যা যেন আর না বাড়ে, সে বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে বলে মন্তব্য করেন শাবনাজ জেহরিন। শিক্ষার্থীদের ইন্টারনেটের সুরক্ষা সম্পর্কে কতটুকু জ্ঞান আছে, তা–ও উঠে আসে এই জরিপে। জরিপে অংশ নেওয়া ৬৫ শতাংশ শিক্ষার্থী বলেছে, তারা বিভিন্ন বার্তা ব্লক করতে পারে। ৪৪ শতাংশের সেটিংয়ের জ্ঞান আছে। ৩২ শতাংশ ছেলে বলেছে, তাদের কোনো তদারকি নেই। এ নিয়ে মা–বাবা কোনো প্রশ্ন করছেন না। ২৪ শতাংশ মেয়ের ক্ষেত্রেও একই ধরনের তথ্য এসেছে। ৬৩ শতাংশ শিশু নিজেদের কক্ষে ব্যক্তিগতভাবে ইন্টারনেট ব্যবহার করছে। ৪৯ শতাংশ শিশু মা–বাবার ফোন ব্যবহার করে। আর জরিপে অংশ নেওয়া ৩৭ শতাংশ শিশুর নিজেদের স্মার্টফোন আছে, সেখানে ইন্টারনেট ব্যবহার করছে। ৯৪ শতাংশ শিশুর সামাজিক মাধ্যমে অ্যাকাউন্ট আছে। ৪২ শতাংশ শিশু প্রতিদিন ইন্টারনেট ব্যবহার করছে। আর ৩৩ শতাংশ চ্যাট করার জন্য ইন্টারনেট ব্যবহার করছে।
অনুষ্ঠানে ইউনিসেফের তৈরি করা একটি সচেতনতামূলক ভিডিও দেখানো হয়। ভার্চ্যুয়াল সংলাপ অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ফিরোজ চৌধুরী।
মহিলা ‍ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (শিশু ও সমন্বয়) মো. মুহিবুজ্জামান বলেন, শিশুর প্রারম্ভিক বিকাশ থেকে শুরু করে বিভিন্ন বিষয়ে তাঁরা কাজ করে যাচ্ছেন। শিশুদের নিরাপদ ইন্টারনেট ব্যবহারের জন্য কমিকস বই প্রকাশের পরামর্শ দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোবটিকস অ্যান্ড মেকাট্রনিকস বিভাগের অধ্যাপক লাফিফা জামাল।
ঢাকার গবর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক মো. আবু সাঈদ ভূঁইয়া বলেন, শিক্ষাক্রমে নিরাপদ ইন্টারনেট ব্যবহারের বিষয়টি থাকলে সচেতনতা বাড়বে।
শিশু ও বড়দের ক্ষেত্রে অনলাইন নিরাপত্তার বিষয়গুলো আলাদা আলাদা ভাগে দেখতে হবে বলে জানান ঢাকা মহানগর পুলিশের সাইবার সিকিউরিটি ও ক্রাইম ডিভিশনের জ্যেষ্ঠ সহকারী কমিশনার সৈয়দ নাসিরুল্লাহ।
সচেতনতার অভাবে ব্যক্তিগত তথ্য শেয়ার হয়ে যায় বলে মনে করেন টেক ব্যাক দ্য টেকের বাংলাদেশের সমন্বয়ক মাহবুবা সুলতানা।
চাইল্ড হেল্পলাইন ‘১০৯৮’ সমন্বয়ক চৌধুরী মোহাম্মদ মোহাইমেন বলেন, শিশুদের সহায়তা দিতে হেল্পলাইন ‘১০৯৮’ কাজ করে চলেছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *