নতুন শিক্ষাক্রমের রূপরেখা অনুমোদনের পর এখন বিষয় অনুযায়ী পাঠ্যবই প্রণয়নের প্রক্রিয়া শুরু করেছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। এতে তথ্য ও তত্ত্বগত বিষয় কমিয়ে ব্যবহারিক শিক্ষায় জোর দেওয়া হচ্ছে। প্রশ্নের ধরনেও পরিবর্তন হবে।

নতুন পাঠ্যবই সম্পর্কে এসব বিষয় জানিয়েছেন এনসিটিবির একাধিক কর্মকর্তা এবং শিক্ষাক্রম তৈরির সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা। তাঁরা বলেছেন, প্রাথমিক স্তরে বইয়ের সংখ্যা এখনকার মতো থাকছে। তবে মাধ্যমিক স্তরে বইয়ের সংখ্যা কমবে। নতুন বইয়ে বিষয়বস্তু উপস্থাপনের ধরন পাল্টে সহজে শিখনের বিষয়ে জোর দেওয়া হচ্ছে।

জানতে চাইলে এনসিটিবির সদস্য (শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক মো. মশিউজ্জামান বলেন, বিস্তারিত শিক্ষাক্রমটি হয়ে গেলেই পাঠ্যবই লেখার কাজ দ্রুত শেষ করা হবে। এখন শুধু প্রথম ও ষষ্ঠ শ্রেণির পাঠ্যবই লেখা হবে। কারণ, আগামী বছর থেকে এই দুই শ্রেণির জন্য পরীক্ষামূলকভাবে (পাইলটিং) নতুন শিক্ষাক্রম চালু হবে। পরের বছর (২০২৩ সাল) থেকে শুরু হয়ে ২০২৭ সালের মধ্যে নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী সব শ্রেণির জন্য নতুন পাঠ্যবই হবে।

দীর্ঘদিন ধরে আলোচনার পর সম্প্রতি প্রাক্-প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত নতুন শিক্ষাক্রমের রূপরেখার অনুমোদন দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নতুন শিক্ষাক্রমে বিদ্যমান পরীক্ষার চেয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধারাবাহিক মূল্যায়নের (শিখনকালীন) ওপর বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সাপ্তাহিক ছুটিরও পরিবর্তন হচ্ছে। প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক স্তরে এক দিনের স্থলে সাপ্তাহিক ছুটি দুই দিন করা হবে।

এনসিটিবি সূত্রে জানা গেছে, কিছু আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে নতুন শিক্ষাক্রমের আলোকে আগামী ১ বা ২ অক্টোবর নতুন পাঠ্যবই প্রণয়নের কাজ শুরু হবে। অক্টোবরের মধ্যে বই লেখার কাজ শেষ করে ছাপার কাজ শুরু করতে চায় এনসিটিবি। এবার শিক্ষাক্রম প্রণয়নের সঙ্গে যাঁরা যুক্ত আছেন, তাঁরাই মূলত বইগুলো লিখবেন।

এখনকার মতো প্রাক্-প্রাথমিকের শিশুদের জন্য নতুন শিক্ষাক্রমেও কোনো বই থাকবে না। নতুন শিক্ষাক্রমে ভাষা ও যোগাযোগসহ শেখার জন্য যে ১০টি ক্ষেত্র নির্ধারণ করা হয়েছে, সেগুলো শিক্ষকেরা ‘শিক্ষক গাইডের’ আলোকে এই স্তরের শিক্ষার্থীদের সমন্বিতভাবে অনুশীলন করাবেন।

প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ানোর জন্য আটটি বিষয় ঠিক করা হয়েছে। এগুলো হলো বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান, সামাজিক বিজ্ঞান, ধর্মশিক্ষা, শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য এবং সুরক্ষা, শিল্প ও সংস্কৃতি। তবে সব বিষয়ের জন্য শিক্ষার্থীরা বই পাবে না। এর মধ্যে এখনকার মতো প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির জন্য বাংলা, ইংরেজি এবং গণিত বিষয়ে শিক্ষার্থীরা পাঠ্যবই পাবে। তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণিতেও এখনকার মতো ছয়টি বই থাকবে। এগুলো হলো বাংলা, ইংরেজি, গণিত, প্রাথমিক বিজ্ঞান, বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় এবং ধর্মশিক্ষা। বাকি দুটি বিষয় শিক্ষকেরা শিক্ষক গাইডের আলোকে পড়াবেন।

প্রাথমিক স্তরের পাঠ্যবইয়ের পরিকল্পনা এমনই আছে উল্লেখ করে এনসিটিবির সদস্য (প্রাথমিক শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক এ কে এম রিয়াজুল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, এসব কাজ কিছুটা তাঁরা এগিয়েও রেখেছেন। বইয়ের নাম অনেকটা এখনকার মতো হলেও বিষয়বস্তু উপস্থাপনে অনেক পরিবর্তন হবে।

বর্তমান শিক্ষাক্রম অনুযায়ী এখন ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণিতে ১২ থেকে ১৪টি বই পড়ানো হয়। নতুন শিক্ষাক্রমে এসব শ্রেণির প্রতিটিতে ১০টি বিষয়ে ১০টি বই থাকবে। এগুলো হলো বাংলা, ইংরেজি, গণিত, জীবন ও জীবিকা, বিজ্ঞান, সামাজিক বিজ্ঞান, ডিজিটাল প্রযুক্তি, শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য এবং সুরক্ষা, ধর্মশিক্ষা এবং শিল্প ও সংস্কৃতি।

এনসিটিবি সূত্রে জানা গেছে, নতুন শিক্ষাক্রমের আলোকে প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক স্তরের পাঠ্যবইয়ে মুখস্থ করার পরিবর্তে বিশ্লেষণমূলক ও অভিজ্ঞতাভিত্তিক শিখন কার্যক্রম বেশি থাকবে। বইগুলো তথ্য দিয়ে ভারাক্রান্ত থাকবে না। যেমন গল্প-কবিতার লেখক পরিচিতিতে সাল, তারিখ ধরে বিস্তারিত থাকবে না। বইয়ের বিন্যাসগত এবং ছবি ও অলংকরণে পরিবর্তন থাকবে। শিক্ষার্থীরা যাতে তার চারপাশের বিষয়বস্তু পাঠ্যবইয়ে প্রতিফলন পায়, তার উল্লেখ থাকবে।

এনসিটিবির একজন সদস্য বলেন, বইয়ের পৃষ্ঠাসংখ্যা (ভলিউম) হয়তো অনেক কমবে না। কিন্তু বিষয়বস্তু উপস্থাপনে লেখার আধিক্য কমিয়ে ছবিসহ অন্যান্য বিষয় গুরুত্ব পাবে।

নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী উচ্চমাধ্যমিক স্তরে (একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণি) বিষয় ও পাঠ্যবইয়ে বড় পরিবর্তন আসছে। বর্তমান শিক্ষাক্রম অনুযায়ী সব শিক্ষার্থীকে বাধ্যতামূলক বাংলা, ইংরেজি এবং তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি পড়তে হয়। নতুন শিক্ষাক্রমে বাংলা ও ইংরেজির পাশাপাশি একটি সমন্বিত বিষয় (শিল্প ও সংস্কৃতি, শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য এবং সুরক্ষা ইত্যাদি কয়েকটি বিষয় নিয়ে তৈরি) বাধ্যতামূলক থাকবে।

বর্তমানে উচ্চমাধ্যমিকে মানবিক, বিজ্ঞান ও ব্যবসায় শিক্ষা—এই তিনটি বিভাগের প্রতিটিতে তিনটি বিষয় নির্ধারিত থাকে। কিন্তু নতুন শিক্ষাক্রমে একজন শিক্ষার্থী চাইলে তিন বিভাগ থেকে তিনটি বিষয় নিয়েও পড়ার সুযোগ পাবে।

এনসিটিবির সূত্রমতে, উচ্চমাধ্যমিক স্তরে নতুন শিক্ষাক্রম শুরু হবে ২০২৬ সালে। তাই এই স্তরে বিষয় নির্বাচন ও পাঠ্যবই এখনো চূড়ান্ত হয়নি। তবে প্রাথমিক ধারণা হলো, বাধ্যতামূলক তিনটি এবং অপর তিনটি বিষয়ের প্রথম পত্রের পরীক্ষা একাদশ শ্রেণিতে নেওয়া হবে। আর দ্বাদশ শ্রেণিতে অপর তিনটি বিষয়ের দ্বিতীয় ও তৃতীয় পত্রের মোট ছয়টি বিষয়ে পরীক্ষা হবে.

নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী, প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত বেশির ভাগ মূল্যায়ন হবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিখনকালীন ধারাবাহিকতার ওপর। প্রকল্পভিত্তিক শিখনচর্চা, অ্যাসাইনমেন্টভিত্তিক কাজ, গ্রুপ ওয়ার্ক, কুইজ, খেলাধুলা, পোস্টার প্রদর্শনীসহ বিভিন্ন সহশিক্ষা কার্যক্রমের মাধ্যমে মূল্যায়নের কাজটি হবে।

এই পদ্ধতিতে শিক্ষকদের বড় ভূমিকা থাকবে। তবে শিক্ষার্থীরাও তাদের সতীর্থদের মূল্যায়ন করবে। এ বিষয়ে উদাহরণ দিয়ে এনসিটিবির একজন সদস্য প্রথম আলোকে বলেন, নতুন শিক্ষাক্রমে শেখানোর অন্যতম একটি পদ্ধতি হলো ‘প্রকল্পভিত্তিক শিখনচর্চা’। যেমন একটি শ্রেণিতে ৩০ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। শিক্ষক তাদের তিনটি দলে ভাগ করে প্রকল্পভিত্তিক শেখার কাজ দেবেন। কাজটি করার পর শিক্ষার্থীরা তা শ্রেণিকক্ষে উপস্থাপন করবে। তার ভিত্তিতে শিক্ষক নম্বর দেবেন। আবার দলের ভেতর থেকেও শিক্ষার্থীরা একে অপরের কাজ মূল্যায়ন করবে।

প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাক্রম প্রণয়নের সঙ্গে যুক্ত আছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক তারিক মনজুর। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, নতুন শিক্ষাক্রমের আলোকে যেভাবে পাঠ্যবই হবে, তাতে মুখস্থ করার প্রবণতা কাজে লাগবে না। বইগুলো তথ্যে ভারাক্রান্ত থাকবে না। নতুন শিক্ষাক্রমটি যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা গেলে শিক্ষায় গুণগত পরিবর্তন আসবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *