সাম্প্রতিক কয়েকটি হত্যার ঘটনায় পরিবারের সদস্যদের মধ্যে আন্তসম্পর্কের ঘাটতি, পারস্পরিক সন্দেহ-অবিশ্বাস, ক্ষোভ ও হতাশাকে প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। গত তিন মাসে গণমাধ্যমে প্রকাশিত ১৪টি খুনের ঘটনা বিশ্লেষণ করে এমনটি বলেছেন তদন্তসংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা।

উল্লিখিত ১৪ ঘটনায় ২২ জন খুন হয়েছেন। সর্বশেষ রাজধানীর পুরান ঢাকার কদমতলীতে মা, বাবা ও বোনকে খুনের ঘটনায়ও প্রধান সন্দেহভাজন হিসেবে গ্রেপ্তার হন পরিবারেরই একজন নারী সদস্য। এখানেও ঘনিষ্ঠ স্বজনদের ওপর রাগ, ক্ষোভ ও অনৈতিক সম্পর্কের সন্দেহ নিষ্ঠুর সিদ্ধান্তের পেছনে কাজ করেছে বলে তদন্ত কর্মকর্তার দাবি। কোনো কোনো হত্যার ঘটনায় নৃশংসতাও দেখা গেছে।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা ঘটনা পর্যবেক্ষণ করে বলছেন, করোনা মহামারিতে দেশে পারিবারিক সহিংসতা বাড়ছে। বিভিন্ন সংস্থার জরিপের তথ্যের সঙ্গে এ বক্তব্যের মিলও পাওয়া যাচ্ছে। গত বছরের মার্চে করোনা শুরুর তিন মাস পর মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন একটি জরিপ করে। তাতে দেখা যায়, করোনা শুরুর পর নারী ও শিশু নির্যাতন বেড়েছে ৩১ শতাংশ। গত বছরের শেষ দিকে প্রকাশিত বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের এক জরিপে বলা হয়, করোনার সময়ে যারা পারিবারিক সহিংসতার শিকার হয়েছে তাদের মধ্যে ৯১ শতাংশ নারী ও কন্যাশিশু। ৮৫ শতাংশ নির্যাতনকারী ঘরের সদস্য। শুধু বাংলাদেশে নয়, করোনার সময় ইংল্যান্ড এবং ওয়েলসে পারিবারিক সহিংসতা বেড়েছে বলে যুক্তরাজ্যের অফিস ফর ন্যাশনাল স্ট্যাটিসটিকসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

এ ১৪টি ঘটনার মধ্যে ৬টি হত্যায় সন্দেহভাজনেরা নারী। এর মধ্যে কদমতলীতে তিন খুনসহ মহাখালী, দিনাজপুর ও খুলনার তিনটি ঘটনা রয়েছে। খুলনায় সৎমায়ের হাতে নৃশংসভাবে খুন হয় এক শিশু। পারিবারিক সহিংসতার এই ১৪ ঘটনায় খুন হওয়া ২২ জনের মধ্যে ৪টি শিশু এবং ২ জন কিশোর।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মাহবুব আলম বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে সামাজিক এবং পারিবারিক সহিংসতার ঘটনা বাড়ছে। এখন মানুষের মধ্যে অসহিষ্ণুতা একটু বেশি কাজ করছে বলে মনে হচ্ছে। তিনি বলেন, লকডাউন এবং বেকারত্ব থেকে মানুষের মধ্যে হতাশা আসতে পারে। করোনা সামাজিক নিরাপত্তাব্যবস্থাকেও একটু আঘাত করেছে বলে মনে হচ্ছে। এ বিষয়ে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে গবেষণা হলে প্রকৃত চিত্র পাওয়া যাবে।

খুনোখুনিতে পরিবারের সদস্যরা

জুন মাসে পারিবারিক সহিংসতার পাঁচটি ঘটনা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, সন্দেহ ও অবিশ্বাস থেকেই হত্যার ঘটনাগুলো ঘটেছে। এই পাঁচটি ঘটনায় ১২ জন খুন হন। এর মধ্যে কদমতলীতে তিন খুন, কুষ্টিয়া শহরে তিন এবং গোয়াইনঘাটে তিন খুনের ঘটনাও রয়েছে। এর বাইরে ১ জুন রাজধানীর মহাখালী ও বনানী এলাকা থেকে এক ব্যক্তির তিন টুকরা লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায় এক নারীকে গ্রেপ্তারের পর পুলিশ বলেছে, ময়না মিয়া নামের ওই ব্যক্তিকে নৃশংসভাবে খুন করে ছয় টুকরা করেছেন তাঁর স্ত্রী ফাতেমা আক্তার। স্বামীর দ্বিতীয় বিয়ে এবং পারিবারিক কলহ থেকে এ ঘটনা ঘটে।

১৮ জুন ঢাকার সাভারে তুচ্ছ ঘটনার জেরে নাজমুল হোসেন ও রায়হান নামের দুই কিশোর খুন হন। তাঁরা সম্পর্কে খালাতো ভাই। এই জোড়া খুনের ঘটনায় শাহজালাল নামের এক তরুণকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। শাহজালাল নিহত রায়হানের ফুফাতো ভাই। শাহজালাল আগে রায়হানদের বাসায় থাকতেন। পুলিশ বলছে, পারিবারিক মনোমালিন্যের কারণে রায়হানদের বাসা থেকে শাহজালাল চলে যান। সেই ক্ষোভ থেকে রায়হান ও তাঁর খালাতো ভাই নাজমুলকে বাসা থেকে ডেকে নিয়ে হত্যা করেন বলে পুলিশের সন্দেহ।

গত মে মাসে ছয়টি ঘটনায় সাতজন খুন হন। এর মধ্যে ৯ মে সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জে পারিবারিক কলহের জের ধরে ছোট ভাইয়ের ছুরিকাঘাতে বড় ভাই ও ভাবি নিহত হন। পুলিশ বলছে, ছোট ভাই রাসেলের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বড় ভাই আলমগীর ও ভাবি মুর্শেদা বেগমের বিরোধ থেকেই এই হত্যাকাণ্ড।

গত ২০ মে রাজধানীর দক্ষিণখানে আজহারুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তিকে খুন করে লাশ ছয় টুকরা করা হয়। আজহারুলের স্ত্রী আসমা বেগম এবং আবদুর রহমান নামে দুজনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। সন্দেহভাজন দুই আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদের পর পুলিশ বলছে, আবদুর রহমানের সঙ্গে আসমার সম্পর্ক আছে। হত্যার পরিকল্পনার সঙ্গে আসমা জড়িত।

এ ছাড়া গত ৬ মে আর্থিক দুরবস্থা নিয়ে কটাক্ষ করায় চাচাতো বোনকে খুন করে এক কিশোর। পারিবারিক কলহের জেরে গত ১৫ মে পাবনার বেড়া উপজেলায় এবং ২৮ মে গাজীপুরের কালিয়াকৈরে স্বামীর হাতে স্ত্রী খুন হন বলে অভিযোগ। ২৮ মে পাবনার ঈশ্বরদীতে স্ত্রী ও ছোট ভাইয়ের হাতে খুন হন এক ব্যবসায়ী। এপ্রিল মাসের তিনটি খুনের ঘটনার মধ্যে পারিবারিক কলহের জেরে বাগেরহাটে ছেলের হাতে মা, দিনাজপুরে স্ত্রীর হাতে স্বামী এবং খুলনায় সৎমায়ের হাতে শিশু খুন হয়।

তদন্ত কর্মকর্তারা এসব ঘটনার পেছনের নানা কারণ চিহ্নিত করলেও বিচারে সময়ক্ষেপণ বা বিচারহীনতার প্রসঙ্গটি তোলেননি। তবে মানবাধিকারকর্মীরা এ প্রসঙ্গটিতেও জোর দিয়েছেন। তাঁরা বলছেন, বিচারহীনতা এবং বিচারের দীর্ঘসূত্রতার কারণে এ ধরনের ঘটনা বন্ধ হচ্ছে না। কদমতলীর ঘটনাটি এর বড় উদাহরণ।

রাজধানীর কদমতলীতে মা, বাবা ও বোনকে হত্যার ঘটনায় আদালতে দোষ স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছে যে মেহজাবিন ইসলাম, তিনি এর আগেও একটি খুনের মামলার আসামি ছিলেন। তাঁর স্বামী শফিকুল ইসলাম ওই খুনের মামলার প্রধান আসামি। ২০১৬ সালে কেরানীগঞ্জে এক ব্যক্তিকে কুপিয়ে হত্যার ঘটনায় মামলাটি হয়। ঘটনার পাঁচ বছর পেরিয়ে গেলেও সে মামলার বিচার শেষ হয়নি। শফিকুল সর্বশেষ তিন খুনের মামলারও আসামি।

মানবাধিকার আইনজীবী সালমা আলী বলেন, বিচারহীনতা এবং বিচারের দীর্ঘসূত্রতা পারিবারিক সহিংসতা বাড়ার অন্যতম কারণ। সমাজে পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব, সামাজিক মূল্যবোধ, অনৈতিক সম্পর্কের জের এবং পারিবারিক শিক্ষার অভাবও এ ধরনের ঘটনার কারণ। তা ছাড়া পারিবারিক সুরক্ষা আইনের যথাযথ প্রয়োগের অভাবকেও তিনি আরেকটি কারণ হিসেবে দেখছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *