কার্যকরের এক দশকেও পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইনে প্রতিকার চাওয়ার বিষয়ে ভুক্তভোগী, আইনজীবীসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের জানাশোনা কম। এ ছাড়া আইন প্রয়োগে দুর্বলতা থাকায় স্বামীর হাতে গুরুতর নির্যাতনের শিকার নারীরা এ আইনে প্রতিকার চাইতে আগ্রহী হন না। আইনে সংস্কার এনে এর প্রয়োগ আরও শক্তিশালী করাসহ বিবাহবিচ্ছেদ হওয়া ও বিধবা নারীদেরও আইনটির আওতায় আনার সুপারিশ করেছেন বক্তারা।
গতকাল বুধবার বেলা ১১টায় একশনএইড বাংলাদেশ আয়োজিত ভার্চ্যুয়াল গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা এ সুপারিশ করেন।
বৈঠকটি সঞ্চালনা করেন একশনএইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ কবির।
বৈঠকে জানানো হয়, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০১৫ সালের জরিপ অনুসারে, ৭২ দশমিক ৬ শতাংশ বিবাহিত নারী জীবদ্দশায় কোনো না কোনো পর্যায়ে স্বামীর মাধ্যমে সহিংসতার শিকার হন। এ বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পত্রিকায় প্রকাশিত খবরের ভিত্তিতে আইন ও সালিশ কেন্দ্র জানিয়েছে, এ সময়ে কমপক্ষে ৩৫৮ জন নারী জীবনসঙ্গী বা পরিবারের সদস্যদের হাতে নিগৃহীত হয়েছেন। ১৮৩ জনের মৃত্যু হয়েছে স্বামীর হাতে।
একশনএইড আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ ২০২০ কর্মসূচি উপলক্ষে আইনটি প্রয়োগের ক্ষেত্রে কার্যকারিতা মূল্যায়নের উদ্যোগ নেয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক তাসলিমা ইয়াসমীন আইনটির ওপর একটি স্বল্পমেয়াদি গবেষণা পরিচালনা করেন।
গবেষণার তথ্য তুলে ধরে তাসলিমা ইয়াসমীন জানান, আইনটির প্রয়োগ দেশের বেশির ভাগ জেলাতেই দুর্বল। কয়েকটি জেলার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের আদালত গবেষণা দলকে জানিয়েছেন, গত ১০ বছরে সংশ্লিষ্ট আইনে একটিও মামলা হয়নি। বরিশালে ১০ বছরে মাত্র একটি মামলা হয়েছে, সেটাও বিচারাধীন। বিচারিক কর্মকর্তাদের কেউ কেউ জানিয়েছেন, গত ১০ বছরে তাঁদের আদালতে মামলা হয়েছে হাতে গোনা। তবে সিলেট, যশোর ও দিনাজপুরে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মামলা হয়েছে। এর পেছনে বেসরকারি সংগঠনগুলোর তৎপরতা রয়েছে।
তাসলিমা ইয়াসমীন বলেন, ভুক্তভোগীদের মধ্যেও আইনের সুরক্ষা ও প্রতিকার বিষয়ে যথাযথ জানাবোঝার ঘাটতি রয়েছে। সাক্ষাৎকার নেওয়া ২০ ভুক্তভোগীর মধ্যে ১৯ জন জানিয়েছেন, তাঁরা এভাবে প্রতিকার পাওয়ার বিষয়ে জানেন না।
গোলটেবিল বৈঠকে সাংসদ আরমা দত্ত বলেন, স্বামীর হাতে নির্যাতনের শিকার যে নারীর বিবাহবিচ্ছেদ হয়ে গেছে, তাঁকেও এই আইনের আওতায় সুরক্ষা পাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। বিধবাদেরও অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। পারিবারিক নির্যাতন এমন এক নির্যাতন, বহু নারী গুমরে গুমরে কাঁদে, তা চার দেয়ালের ভেতরেই থেকে যায়। আইনটি সম্পর্কে প্রচারে কমিউনিটি রেডিওকে ব্যবহার করতে হবে।
মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান নাছিমা বেগম বলেন, পারিবারিক সম্মানের কথা চিন্তা করে অনেক নারী নির্যাতনের ঘটনাগুলো প্রকাশ করতে চান না। নারীকেও নির্যাতনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। মানবাধিকার ইস্যুতে প্রতিটি জেলায় পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা নেবে কমিশন।
নির্যাতনের ঘটনাগুলো প্রকাশ হওয়ার ওপর জোর দিয়ে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) বিশেষ পুলিশ সুপার (ফরেনসিক) রুমানা আক্তার বলেন, সচেতন না হলে মানুষ পুলিশের কাছে আসবে না। আর থানায় অভিযোগ না জানালে পুলিশও কিছু করতে পারবে না। প্রতিটি থানায় নারী হেল্প ডেস্ক চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। অনেক থানায় ইতিমধ্যে চালু হয়েছে। তিনি বলেন, ‘আইনি সহায়তা নিতে পুলিশের কাছে আসুন, অভিযোগ জানান, পুলিশ অবশ্যই ব্যবস্থা নেবে।’
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সারা হোসেন বলেন, এ আইন সম্পর্কে ভুক্তভোগীদের জানাতে ও আইনি সহায়তা দিতে ঘটনার প্রাথমিক পর্যায়ে কাজ করার জন্য প্যারা লিগ্যাল কর্মী রাখার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। বিভিন্ন সংগঠনের মাঠকর্মীরা প্যারা লিগ্যালের ভূমিকা নিতে পারেন। উচ্চ আদালতে এ আইনে প্রতিকার চাওয়ার ঘটনা গত ১০ বছরে ঘটেনি বললেই চলে। এতেই বোঝা যায়, ভুক্তভোগী নারীরা শেষ পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন না। তিনি জানান, আইনটির খসড়া কাজের সময় বিবাহবিচ্ছেদ হওয়া নারীদেরও প্রতিকার পাওয়ার সুযোগ রাখা হয়েছিল। চূড়ান্ত আইন থেকে তা বাদ দেওয়া হয়েছে। বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা দরকার।
গৃহস্থালি কাজে বেশি সময় দিয়েও নারীরা পরিবারে নিগৃহীত হন বলে মন্তব্য করেন গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিসার্চ ইনিশিয়েটিভ বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক মেঘনা গুহঠাকুরতা। তিনি বলেন, গৃহস্থালি কাজে সামান্য ত্রুটি থেকেও নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। কোভিড পরিস্থিতিতে নারী-পুরুষের উপার্জন ক্ষমতা কমে গেছে। ফলে ঝগড়াঝাঁটি, অসন্তোষ বেড়ে পারিবারিক সহিংসতা আরও বেড়ে গেছে।
পারিবারিক সুরক্ষা আইনটি সম্পর্কে নিজের জানাশোনাও কম বলে জানান স্থানীয় বেসরকারি সংগঠন স্বাবলম্বী উন্নয়ন সমিতির ব্যবস্থাপক কোহিনুর বেগম। তিনি বলেন, তাঁর কর্ম এলাকা ময়মনসিংহ, জামালপুর ও নেত্রকোনায় পারিবারিক সহিংসতার অনেক ঘটনা ঘটলেও এ আইনে প্রতিকার চাওয়া হয়নি। তিনি বলেন, নির্যাতনের শিকার নারীর কথা শোনার মানুষের খুব অভাব। নারী বুঝতে পারে না কোথায় গিয়ে সহায়তা চাইবে।