‘আব্বা গো ছাড়ি দে’- নিজের সম্মান রক্ষার করুণ আর্তনাদ ছিল নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের গৃহবধূটির। কিন্তু আর্তচিৎকার, ক্ষমা-প্রার্থনা কিছুতেই মন গলেনি কিছু বখাটের। অট্টহাসি দিয়ে বিবস্ত্র করেছে গৃহবধূকে, নানাভাবে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে নির্যাতন করেছে। নির্যাতন করার সময় ধারণ করা ভিডিও ফেসবুকে দেয়ার কথাও বলছিল। অবশেষে ফেসবুকে প্রকাশও করেছে। তিন মিনিটের ভিডিও হৃদয় নাড়ানো, বিবেক জাগানো। অসহ্য, অসহনীয় কেউ পুরো ভিডিওটি দেখতেই পারছেন না। ২০২০ সালের এমন আধুনিকতায় এসে দেখতে হচ্ছে নারীকে বিবস্ত্র করে নির্যাতনের দৃশ্য। আবার সেই দৃশ্যের ভিডিও ধারণ করে ছাড়া হচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। দেশ থেকে বিদেশ মুহূর্তেই ভাইরাল। ৩৫ বছর বয়সী দুই সন্তানের মায়ের বিবস্ত্র ভিডিও দেখে বাকরুদ্ধ সবাই। ক্ষোভ জানানোর ভাষাও অনেকের স্তব্ধ! মানুষরূপী সেই সংঘবদ্ধ জানোয়ারগুলোর জন্য বিচারের দাবিতে সরব অনলাইন-অফলাইন।
বিচারবহির্ভূত হত্যাকা- সমর্থন না করলেও এই একটি ঘটনায় অনেকেই বিচার নয়, একটি বন্দুকযুদ্ধ চায়। সব দাবি এক স্রোতে এসে মিশেছে, ‘বিচার চাই’, ‘একটি ক্রসফায়ার চাই’। ঘটনায় জড়িত চারজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। নির্যাতিত ভিকটিমের পরিবারকে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা দিতে স্থানীয় পুলিশ সুপারকে (এসপি) নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট। সেই সঙ্গে ভিডিওটি অনলাইন মাধ্যম থেকে সরিয়ে নিতে বিটিআরসিকে নির্দেশ দিয়েছে।
ঘটনাটি গত মাসের দুই তারিখের হলেও প্রকাশ পেয়েছে ৩২ দিন পর। সেদিন ২ সেপ্টেম্বর রাতে নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার একলাশপুর ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ডের খালপাড় এলাকার নূর ইসলাম মিয়ার বাড়িতে ওই গৃহবধূর বসতঘরে ঢুকে তার স্বামীকে পাশের কক্ষে বেঁধে রাখে স্থানীয় বাদল ও তার সহযোগীরা। এরপর গৃহবধূকে ধর্ষণের চেষ্টা করে তারা। এ সময় গৃহবধূ বাধা দিলে তারা বিবস্ত্র করে বেধড়ক মারধর করে মোবাইলে ভিডিও চিত্র ধারণ করে। বার বার আকুতি জানিয়েও নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা পায়নি গৃহবধূ। নির্যাতনের ঘটনার ৩২ দিন পরে ৯ জনকে আসামি করে রবিবার রাত ১টার দিকে ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগে মামলা করেন নির্যাতিত গৃহবধূ (৩৫)। মামলার এজাহারে ওই নারী অভিযোগ করেছেন, তার স্বামীকে বেঁধে রেখে আসামিরা তাকে ধর্ষণের চেষ্টা করে। তারা এ ঘটনার ভিডিওচিত্র ধারণা করে। গত এক মাস ধরে তারা এই ভিডিও ছড়িয়ে দেয়ার কথা বলে তাকে অনৈতিক প্রস্তাব দিচ্ছিল। তিনি এই অনৈতিক প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় তারা ফেসবুকে ভিডিওটি ছেড়ে দেয়।
এদিকে, গৃহবধূকে বিবস্ত্র করে নির্যাতনের ঘটনায় সর্বশেষ চার জনকে গ্রেফতারের খবর পাওয়া গেছে। এর মধ্যে আগে গ্রেফতার হওয়া মোঃ আব্দুর রহিম ও রহমত উল্লাহর দুই মামলায় ৬ দিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ।
নির্যাতিত নারীর পরিবারকে নিরাপত্তা দিতে নির্দেশ হাইকোর্টের ॥ নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের গৃহবধূকে বিবস্ত্র করে নির্যাতনের ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওটি অনলাইন মাধ্যম থেকে সরিয়ে নিতে বিটিআরসিকে নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট। বিটিআরসিকে বলা হয়েছে একটি ভিডিওর কপি সংরক্ষণে রাখতে। ২৮ অক্টোবর এ বিষয়ে প্রতিবেদন জমা দেবেন বেগমগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি)। একই সঙ্গে ভিকটিমের পরিবারকে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা দিতে স্থানীয় পুলিশ সুপারকে (এসপি) নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
একইসঙ্গে ওই নারীর নিরাপত্তা, জবানবন্দী নেয়া, দুষ্কৃতিকারীদের বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা গ্রহণসহ সার্বিক ঘটনায় স্থানীয় আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কোন অবহেলা আছে কি না তা অনুসন্ধানে নোয়াখালীর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে তিন সদস্যের একটি কমিটি করে দিয়েছে হাইকোর্ট। কমিটিকে ১৫ কর্মদিবসের মধ্যে হাইকোর্টের রেজিস্ট্রারের কাছে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। জেলার সমাজসেবা কর্মকর্তা ও চৌমুহনী সরকারী এস এ কলেজের অধ্যক্ষকে কমিটিতে রাখা হয়েছে। দেশজুড়ে ক্ষোভ তৈরি করা নির্যাতনের এ ঘটনা সোমবার নজরে আনার পর বিচারপতি মোঃ মজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি মোঃ মহিউদ্দিন শামীমের ভার্চুয়াল হাইকোর্ট বেঞ্চ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে রুলসহ এ আদেশ দেয়। আদালতে আজ শুনানি করেন সুপ্রীমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি এ এম আমিন উদ্দিন ও সম্পাদক ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল, এ্যাডভোকেট জেডআই খান পান্না, ইয়াদিয়া জামান, তানজিম আল ইসলাম, আব্দুল্লাহ আল মামুন ও এ এম জামিউল হক ফয়সাল।