দেশে করোনার প্রথম ঢেউয়ের তুলনায় দ্বিতীয় ঢেউয়ে মৃত্যু বেশি হচ্ছে। দুটি প্রধান হাসপাতালের চিকিৎসকেরা বলেছেন, করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর রোগীরা তীব্র উপসর্গ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন। তাঁদের অবস্থা খুব দ্রুত অবনতি হওয়ার পাশাপাশি ফুসফুস তুলনামূলকভাবে অল্প সময়ে ক্ষতিগ্রস্ত হতে দেখা যাচ্ছে। তবে এসবের পেছনের সুনির্দিষ্ট কারণ জানা যাচ্ছে না।
করোনায় প্রতিদিন মৃত্যু বেড়ে যাওয়ায় সাধারণ মানুষ ছাড়াও চিকিৎসকদের মধ্যে উদ্বেগ বেড়েছে। খুব শিগগির মৃত্যু কমে আসার কোনো সম্ভাবনাও তাঁরা দেখতে পারছেন না। একাধিক জনস্বাস্থ্যবিদ প্রথম আলোকে বলেছেন, মহামারি মোকাবিলার মৌলিক বিষয়গুলোতে জোর না দিলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হওয়ার আশঙ্কা আছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ২৪ ঘণ্টায় করোনায় ৭৪ জনের মৃত্যুর তথ্য জানিয়েছে। এটি গত ১৩ মাসে দেশে এক দিনে মহামারিতে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু। এ নিয়ে দেশে করোনায় মোট ৯ হাজার ৫২১ জনের মৃত্যু হলো। গতকাল দেশে করোনা সংক্রমণের ১৩তম মাস (৮ মার্চ ২০২১ থেকে ৮ এপ্রিল ২০২১) পূর্ণ হয়েছে।

সংক্রমণের ১২তম মাসের তুলনায় এই মাসে নতুন রোগী বেড়েছে ৭৪৪ শতাংশ, আর মৃত্যু বেড়েছে ২৮০ শতাংশ। গত এক বছরে এক মাসের ব্যবধানে এত বেশি সংক্রমণ ও মৃত্যু দেখা যায়নি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হচ্ছে ৬০ বা তাঁর বেশি বয়সী মানুষের। আর করোনায় যাঁদের মৃত্যু হচ্ছে, তাঁদের ৫৮ শতাংশই ঢাকা বিভাগে।
গত বছর রাজধানীর মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে করোনায় মৃত্যুর কারণ জানার চেষ্টা করেছিলেন একদল গবেষক ও চিকিৎসক। তাঁরা ২০২টি মৃত্যুর তথ্য পর্যালোচনা করেছিলেন। ওই গবেষণায় নেতৃত্ব দিয়েছিলেন হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের প্রধান রুবিনা ইয়াসমিন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘হাসপাতালে আসার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে অধিকাংশ মৃত্যু হতে আগেও দেখা গেছে, এবারও দেখা যাচ্ছে। যাঁরা দীর্ঘস্থায়ী রোগে ভুগছেন, তাঁদের মধ্যে মৃত্যুহার বেশি। এর বাইরে এবার নতুন কিছু বিষয় দেখা যাচ্ছে, যা গত বছর দেখা যায়নি।’
নতুন কী দেখা যাচ্ছে
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা বলেছেন, মৃদু, মাঝারি ও তীব্র উপসর্গ নিয়ে রোগীরা হাসপাতালে ভর্তি হন। তীব্র উপগর্স থাকা ব্যক্তির মৃত্যুর ঝুঁকি বেশি থাকে। তবে গত বছরের চেয়ে এবার তীব্র উপসর্গ নিয়ে ভর্তি রোগীর সংখ্যা বেশি।
চিকিৎসকেরা বলেছেন, গত বছরের চেয়ে এই দুটি হাসপাতালে অক্সিজেন সরবরাহ ব্যবস্থার উন্নতি হয়েছে। তারপরও প্রয়োজনীয় অক্সিজেন সময়মতো সব রোগীকে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। অন্য আয়োজনের স্বল্পতাও প্রত্যক্ষ করছেন চিকিৎসকেরা। যেমন নিবিড় পরিচর্যা ইউনিট আইসিইউ ও এইচডিইউ শয্যার মতো ব্যবস্থার সংকট আছে, এসব পরিচালনার দক্ষ জনবলেরও ঘাটতি আছে। গতকাল মুগদা হাসপাতালের একজন কর্মকর্তা বলেছেন, হাসপাতালে আইসিইউ ও এইচডিইউ শয্যা আছে ২৪টি। সব কটিতেই রোগী ভর্তি। কিন্তু তিনজন রোগী আছেন, যাঁদের ওই দুই কক্ষে রাখা জরুরি।
মুগদা হাসপাতালের চিকিৎসকেরা আরও বলেছেন, এবার রোগীদের মধ্যে অক্সিজেন চাহিদা বেশি দেখা যাচ্ছে। হাসপাতালে প্রতিদিন গড়ে ৩০ জন রোগী ভর্তি হচ্ছেন, এঁদের ২৪–২৫ জনকেই অক্সিজেন দিতে হচ্ছে। গত বছর এই সংখ্যা অনেক কম ছিল।
দ্বিতীয় কারণটি ফুসফুস–সংক্রান্ত। করোনা শ্বাসতন্ত্রের রোগ, এতে অনেকের ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত হয়। চিকিৎসকেরা বলছেন, গতবার দেখা গেছে, আক্রান্ত হওয়ার পর হয়তো এক সপ্তাহ পর ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কিন্তু এবার কম সময়ে ফুসফুস আক্রান্ত হচ্ছে বলে তাঁরা ধারণা করছেন।
একই ধরনের পর্যবেক্ষণ ঢাকা মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ টিটো মিয়ার। এই মেডিসিন বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘মনে হচ্ছে, এবার খুব দ্রুতই ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।’
কারণ কী জানতে চাইলে টিটো মিয়া বলেন, ‘আমরা এটা জানার চেষ্টা করছি।’ এটা কি নতুন করোনাভাইরাসের ধরনে (ভেরিয়েন্ট) আক্রান্ত হওয়ার কারণে হচ্ছে—এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘করোনাভাইরাসের যুক্তরাজ্য, ব্রাজিল বা দক্ষিণ আফ্রিকার ভেরিয়েন্টের কারণে এটা হচ্ছে কি না, তা বলার সময় এখনো আসেনি। তবে এটা একটি সম্ভাব্য কারণ হতে পারে।’

এখন করণীয়
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) পরিচালক তাহমিনা শিরীন প্রথম আলোকে বলেন, করোনার ব্যাপারে মানুষের ভয় কমে গেছে।
রোগের উপসর্গ দেখা দিলেও অনেকে পাত্তা দিচ্ছে না। যখন হাসপাতালে আসছে, তখন অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে। সময় থাকতে মানুষকে হাসপাতালে আসতে হবে।
গতকাল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্যে দেখা গেছে, ২৪ ঘণ্টায় সুস্থ হয়েছেন ৩ হাজার ৩৯১ জন। আর আক্রান্ত বলে শনাক্ত হয়েছেন দ্বিগুণের বেশি, ৬ হাজার ৮৫৪ জন।
যাঁরা আক্রান্ত হচ্ছেন, তাঁদের বড় অংশটি বাড়িতে থেকে চিকিৎসা নিচ্ছে। কেউ পরিচিত চিকিৎসকের কাছ থেকে, কেউ সরকারের স্বাস্থ্য বাতায়নের মাধ্যমে। বাড়িতে থেকে চিকিৎসা নেওয়া এসব রোগীর বাস্তব পরিস্থিতি কী, সে বিষয়ে কারও কাছে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই, এ বিষয়ে কোনো নজরদারির ব্যবস্থাও নেই।
হাসপাতালে ও বাড়িতে রোগীর কী চিকিৎসা হচ্ছে, তা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের যথাযথ পর্যবেক্ষণে থাকা জরুরি উল্লেখ করে অধিদপ্তরের পাবলিক হেলথ অ্যাডভাইজারি কমিটির সদস্য আবু জামিল ফয়সাল প্রথম আলোকে বলেন, অনেক মানুষ মাস্ক পরছে না, স্বাস্থ্যবিধি মানছে না। অন্যদিকে পরীক্ষার পরিমাণ কিছু বাড়লেও সরকার আইসোলেশন (বিচ্ছিন্নকরণ), কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং (শনাক্ত হওয়া ব্যক্তির সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিকে খুঁজে বের করা) বা কোয়ারেন্টিন (সঙ্গনিরোধ) করছে না। তাই সংক্রমণের সমান্তরালে হাসপাতালের ওপর চাপ বাড়ছে, মৃত্যু বাড়ছে। তিনি বলেন, ‘মহামারি নিয়ন্ত্রণ করতে হলে সরকারকে মৌলিক কাজগুলো অবশ্যই করতে হবে।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *