প্রতিবন্ধী না হয়েও লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মাইদুল ইসলাম সরকার ওরফে বাবু (৩১) অসচ্ছল প্রতিবন্ধী ভাতার কার্ড করে ভাতা তুলেছেন। ওই নেতা স্নাতকোত্তর পাস ব্যবসায়ী। সর্বশেষ উপজেলা পরিষদের নির্বাচনে তিনি ভাইস চেয়ারম্যান পদে নির্বাচনও করেছেন। তাঁকে এই কার্ড করে দিয়েছে উপজেলা সমাজসেবা কার্যালয়। শুধু তা–ই নয়, এই ছাত্রলীগ নেতা প্রতিবন্ধী কার্ড করে প্রতিবন্ধী কোটায় সরকারি চাকরির চেষ্টাও করেন বলে জানা গেছে।
সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন সমাজসেবা অধিদপ্তরের আদিতমারী উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে মাইদুল ইসলাম সরকারের নামে ইস্যু করা বইয়ের নম্বর ৭৯৬। সোনালী ব্যাংক আদিতমারী শাখায় তাঁর সঞ্চয়ী হিসাব নম্বর ৫২০১৯০১০১৯৬০৯। ওই ৭৯৬ নম্বর বইয়ের বিপরীতে মাইদুল ইসলাম সরকার দুই দফায় সর্বমোট ১১ হাজার ২৫০ টাকা উত্তোলন করেছেন।
আদিতমারী উপজেলা সমাজসেবা অফিসারের কার্যালয় ও সোনালী ব্যাংক লিমিটেডের আদিতমারী শাখার ব্যাংক হিসাব বিবরণী সূত্রে জানা যায়, ২০২০ সালের ৬ অক্টোবর সেখানে ৯ হাজার টাকা অসচ্ছল প্রতিবন্ধী ভাতা হিসেবে জমা হয়। এই টাকা মাইদুল ওই বছর ২০ অক্টোবর উত্তোলন করেন। এরপর দ্বিতীয় দফায় গত ১৫ মার্চ একই খাত থেকে ভাতা হিসেবে আরও ২ হাজার ২৫০ টাকা সংশ্লিষ্ট ব্যাংক হিসেবে জমা হয়। এই টাকা তিনি গত ২৩ মার্চ উত্তোলন করেন।অসচ্ছল প্রতিবন্ধী ভাতার কার্ড করে ভাতা তুলেছেন।
আদিতমারীর ভাদাই ইউনিয়নের বসিনটারী গ্রামের নজরুল ইসলাম সরকারের ছেলে তিন ছেলের মধ্যে মেজ মাইদুল ইসলাম। মাইদুলের বড় ভাই একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায় (এনজিও) চাকরি করেন, সবার ছোট ছেলে গণমাধ্যমকর্মী। মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান মাইদুল রংপুর কারমাইকেল কলেজ থেকে ২০১৬ সালে ইতিহাসে স্নাতকোত্তর করেন। ২০১৯ সালে তিনি বিয়ে করেন এবং বর্তমানে তিনি এক কন্যাসন্তানের জনক। রাজনীতির পাশাপাশি ব্যবসায় যুক্ত মাইদুল সর্বশেষ উপজেলা পরিষদের নির্বাচনে ভাইস চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন করে পরাজিত হন। মাইদুল ২০১৫-২০১৭ মেয়াদে আদিতমারী উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচিত হন। ওই কমিটি মেয়াদোত্তীর্ণ হলেও নতুন করে আর কমিটি হয়নি।
যোগাযোগ করা হলে মাইদুল ইসলাম গত বৃহস্পতিবার বিকেলে মুঠোফোনে বলেন, ‘অসচ্ছল প্রতিবন্ধী ভাতা হিসেবে আমার নামে দেওয়া সমুদয় টাকা ফেরত দিতে চাই। আমি এ জন্য মাসখানেক আগে আদিতমারী উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা রওশন আলী মণ্ডলকে মৌখিকভাবে বলেছি।’
প্রতিবন্ধী কার্ড নেওয়ার প্রশ্নে মাইদুল বলেন, ‘২০১৮ সালের ১০ ফেব্রুয়ারিতে আদিতমারীতে আমার ওপরে প্রতিপক্ষের লোকজন হামলা করে। এতে আমি গুরুতর আহত হই। আমার ডান হাতের একটা আঙুলে বিকলঙ্গতা দেখা দেয়। চিকিৎসকের প্রত্যয়নও আছে। তখন আমি ভেবেছিলাম, একটা প্রতিবন্ধী কার্ড করব। সেই হিসেবে পরবর্তী সময়ে প্রতিবন্ধিতা শনাক্তকরণ জরিপ ফরম ২০১৮ পূরণ করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দিই। আমি ভেবেছিলাম, রাজনীতি বাদ দিয়ে প্রতিবন্ধী কোটায় একটা সরকারি চাকরি করব, সেটা হয়নি। পরে অসচ্ছল প্রতিবন্ধী ভাতা হয়। আমি তখন কিছু না ভেবে টাকাটা গ্রহণ করি।’ আপনি প্রতিবন্ধী কি না, প্রশ্নে মাইদুল বলেন, তিনি এখন সম্পূর্ণ সুস্থ। এটা করা ঠিক হয়নি বলে তিনি দাবি করে বলেন, ‘টাকাটা ফেরত দিতে চাই।’
প্রতিবন্ধিতা শনাক্তকরণ জরিপ ২০১৮ ঘেঁটে দেখা যায়, মাইদুল দুর্ঘটনাজনিত শারীরিক মৃদু টাইপের প্রতিবন্ধী বলে ফরমে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে এ–সংক্রান্ত চিকিৎসকের প্রত্যয়নে তিনি মাঝারি মাত্রার শারীরিক প্রতিবন্ধী বলে উল্লেখ করেছেন চিকিৎসক। প্রত্যয়নটি করেছেন আদিতমারী উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) নূর আরেফিন প্রধান। প্রত্যয়নটি তাঁর স্বাক্ষরের স্থানে ২০২০ সালের ২৩ জুন তারিখ উল্লেখ রয়েছে। একই তারিখে প্রতিবন্ধিতা–সংক্রান্ত সরকারি ফরমে স্বাক্ষর করেন আদিতমারী উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা রওশন আলী মণ্ডল।
জানতে চাইলে আদিতমারী উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা রওশন আলী মণ্ডল বলেন, মাইদুল ইসলাম সরকার এখন আর প্রতিবন্ধী ভাতা তুলছেন না। এখন মুঠোফোন ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ভাতার টাকা দেওয়া হচ্ছে। মাইদুল ইসলাম অনলাইনে নিবন্ধন করেননি। আদিতমারীর ভাদাই ইউনিয়নে অসচ্ছল প্রতিবন্ধী ভাতাপ্রাপ্ত ৯৯০ জনের মধ্যে মাইদুল ইসলাম সরকারসহ মোট ছয়জন অনলাইনে নিবন্ধন করেননি। তাঁদের সবার ভাতার বই বর্তমানে ফাঁকা আছে।
মাইদুল ইসলামকে প্রতিবন্ধী কার্ড করে দেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘সে সময় মাত্র ১৯ দিন আগে আমি এই উপজেলায় যোগদান করি। সব প্রসেস শেষ করে আমার সামনে ফাইল এসেছিল, আমি তাতে স্বাক্ষর করি।’ তিনি আর কিছু বলতে রাজি হননি।
চিকিৎসক নূর আরেফিন প্রধান আদিতমারী থেকে বদলি হয়েছেন বলে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি। এদিকে আদিতমারী উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি কামাল হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।