এমন বিতর্ক কেউ প্রত্যাশা করেনি। কেউ ভাবেনি নিজের গায়ে কেরোসিন ঢেলে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নিজেই আগুন ধরিয়ে দেবেন। গত মঙ্গলবার যুক্তরাষ্ট্রের ক্লিভল্যান্ডে ডেমোক্রেটিক প্রতিদ্বন্দ্বী জো বাইডেনের সঙ্গে অনুষ্ঠিত প্রথম নির্বাচনী বিতর্ক তাঁর বেপরোয়া ব্যবহারের কারণে এতটাই অরাজক ও বিশৃঙ্খল হয়ে পড়ে যে কেউ কেউ একে ‘আমেরিকার জন্য গভীর লজ্জার এক ঘটনা’ বলে বর্ণনা করেছেন। কোনো কোনো মহল থেকে অবশিষ্ট বিতর্কগুলো বাতিল করার দাবিও উঠেছে।

বিতর্কের প্রথম মুহূর্ত থেকে ট্রাম্প নিজের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বারবার প্রতিপক্ষের কথা ছিনিয়ে নিজে বলতে থাকেন। বিতর্কের সঞ্চালক ফক্স নিউজের উপস্থাপক ক্রিস ওয়ালেস তাঁকে বিতর্কের সর্বসম্মত নিয়মবিধি মেনে চলার অনুরোধ করেও থামাতে পারেননি। ‘মি. প্রেসিডেন্ট, আপনি বাধা দিচ্ছেন, নিয়ম মানছেন না,’ এ কথা বলেও কোনো ফল মেলেনি। একপর্যায়ে বাইডেন গলা উঁচিয়ে বলেন, ‘আপনি কি একটু চুপ করবেন?’ তিনি ট্রাম্পকে ‘ক্লাউন’ বলেও ভর্ৎসনা করেন।

বিতর্কের উদ্দেশ্য ছিল উভয় প্রার্থীর কাছ থেকে তাঁদের সাফল্য-ব্যর্থতার একটি খতিয়ান নেওয়া এবং প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে প্রধান জাতীয় সমস্যাগুলো সমাধানে তাঁরা কী করবেন, সে বিষয়ে একটি সম্যক ধারণা পাওয়া। কিন্তু কোনো প্রশ্নেরই অর্থপূর্ণ জবাব পাওয়া যায়নি। কার্যত প্রায় পুরোটা সময় ট্রাম্প পাগলা হাতির মতো পুরো মঞ্চ দাপিয়ে বেড়ালেন। ফলে, তেমন কিছু না করেও অনায়াসে বিতর্কে বিজয়ী হলেন জো বাইডেন।
এই সন্ধ্যার সবচেয়ে স্মরণীয় ও নিন্দনীয় মুহূর্ত ছিল বিতর্কের একদম শেষে। ক্রিস ওয়ালেস প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে বর্ণবাদী দাঙ্গার সঙ্গে যুক্ত শ্বেত শ্রেষ্ঠত্ববাদী গ্রুপগুলোকে নিন্দা করার আহ্বান জানান। তাঁর প্রশ্নের জবাবে ট্রাম্পের প্রতিক্রিয়া ছিল, ‘নিন্দা আমি করব, কিন্তু আমি তো দেখি ডান নয়, অধিকাংশ সহিংসতা হচ্ছে বামপন্থীদের হাতে।’ শ্বেত শ্রেষ্ঠত্ববাদীদের নিন্দা করার দাবি পুনরায় উঠলে ট্রাম্প তারস্বরে প্রশ্ন করেন, ‘কাকে নিন্দা করতে হবে, একজনের নাম করুন?’ জবাবে বাইডেন ফ্যাসিবাদী হিসেবে পরিচিত সশস্ত্র মিলিশিয়া গ্রুপ ‘প্রাউড বয়েস’-এর নাম করলে ট্রাম্পের জবাব ছিল, ‘আমি তাদের “সরে দাঁড়াতে” ও “অপেক্ষা করতে” বলব।’

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট কোনো ফ্যাসিস্ট দলকে এমন খোলামেলাভাবে সময়মতো হামলার জন্য অপেক্ষা করার নির্দেশ দেবেন, এ ছিল সম্পূর্ণ অভাবিত এক ঘটনা। ট্রাম্পের এই নির্দেশ শোনামাত্রই প্রাউড বয়েজ ‘সরে দাঁড়াও ও অপেক্ষা করো’ স্লোগান লিখে তা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়। এই গ্রুপের নেতা হিসেবে পরিচিত জো বিগস সোল্লাসে জানান, ট্রাম্পের কথা তাঁদের জন্য ‘অন্য পক্ষকে আঘাত হানার প্রস্তুতির নির্দেশ’। এই গ্রুপের ওয়েবসাইটে এক তাৎক্ষণিক ভিডিওতে ঘোষণা করা হয়, ‘হ্যাঁ স্যার, আমরা প্রস্তুত’।

দ্বিতীয় নিন্দনীয় মুহূর্ত ছিল নির্বাচনী ফলাফল মানতে ট্রাম্পের অস্বীকৃতি। নির্বাচনী অনিয়মের পুরোনো ও অপ্রমাণিত অভিযোগ তুলে তিনি নিজের সমর্থকদের ভোট প্রদানের ওপর কড়া নজর রাখার পরামর্শ দেন। ‘অভাবিত প্রতারণা হবে’, তিনি সাবধান করে দেন এবং বলেন নির্বাচনের ফলাফল সুপ্রিম কোর্টেই নির্ধারিত হবে। অন্যদিকে জো বাইডেন সরাসরি দর্শকদের দিকে তাকিয়ে সবাইকে ভোট প্রদানে উৎসাহ দেন। তিনি অভিযোগ করেন, ট্রাম্প সব সময় চেষ্টায় আছেন বিভেদ বাড়াতে। ‘সবাইকে শান্ত হতে বলার পরিবর্তে তিনি আগুনে আরও তেল ঢালতে আগ্রহী।’

পারিবারিক আক্রমণ
বাইডেনের ছেলেদের বিষয়ে ট্রাম্পের কদর্য মন্তব্য ছিল এই বিতর্কের আরও একটি অনভিপ্রেত মুহূর্ত। তাঁর পরলোকগত ছেলে বো বাইডেন সামরিক বাহিনীর সদস্য হিসেবে ইরাকে দায়িত্ব পালন করেছেন, সে কথা উল্লেখ করে বাইডেন মনে করিয়ে দেন যে ট্রাম্প এর আগে সেনাসদস্যদের ‘দুর্ভাগা’ ও ‘নির্বোধ’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। ‘আমার ছেলে দুর্ভাগা বা নির্বোধ ছিল না, সে ছিল একজন প্রকৃত দেশপ্রেমিক।’ বাইডেনের সে কথা ছিনিয়ে নিয়ে ট্রাম্প বলেন, ‘সত্যি, আপনি কি হান্টারের কথা বলছেন?’

হান্টার বাইডেনের ছোট ছেলে এবং তিনি ইউক্রেনের একটি গ্যাস কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদের সদস্য থাকায় ট্রাম্পের অভিশংসন শুনানিতে আলোচনায় আসেন। হান্টার বাইডেন ইউক্রেন ও রাশিয়ার সঙ্গে অর্থ চালাচালির সঙ্গে জড়িত, এমন অভিযোগ ট্রাম্প অনেক দিন থেকেই করছেন, যদিও এর কোনোটাই প্রমাণিত হয়নি।

তিনি যে সামরিক বাহিনীর সদস্যদের ‘নির্বোধ’ বলে উপহাস করেছেন, সে কথার কোনো জবাব না দিয়ে ট্রাম্প উল্টো অভিযোগ করেন, বাইডেন সেনাসদস্যদের ‘স্টুপিড বাস্টার্ড’ বা নির্বোধ ও জারজ বলে অভিহিত করেছেন। তিনি এমন অভিযোগও করেন, বাইডেন বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বনিম্ন নম্বর পেয়ে পাস করেন। ‘আমার কাছে কে কতটা চৌকস, সে কথা বলতে আসবেন না,’ তিনি কটাক্ষ করে বলেন। বিরক্ত ও অতিষ্ঠ বাইডেন এই পর্যায়ে বলে ওঠেন, আপনি এবার একটু থামবেন?

জনমতে পিছিয়ে থাকা ট্রাম্পের জন্য এই বিতর্ক ছিল নিজের অনুগত সমর্থকদের বাইরে স্বতন্ত্র ভোটারদের তাঁর দিকে টানার একটি সুযোগ। কিন্তু বিতর্কের কোনো পর্যায়েই তিনি তেমন কোনো চেষ্টা করেননি। তিনি একের পর এক মিথ্যাকে সত্য বলে চালানোর চেষ্টা করেন, কিন্তু টিভি ভাষ্যকারেরা প্রায় তাৎক্ষণিকভাবে সে মিথ্যা চোখে আঙুল দিয়ে দেখানোর ফলে তিনি কার্যত বস্ত্রহীন হয়ে পড়েন। ট্রাম্পের সমর্থকেরা পর্যন্ত বলতে বাধ্য হন, তিনি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছেন। এমন ব্যবহার কোনো প্রেসিডেন্টের পক্ষে মোটেই শোভনীয় নয়।

এমনকি ট্রাম্পের নিকট মিত্র হিসেবে পরিচিত সাবেক সিনেটর রিক সান্টোরাম বলেছেন, ট্রাম্পের এই দুর্ভাগ্যজনক ব্যবহারের ফলে সবচেয়ে ক্ষিপ্ত হবেন সেই সব রিপাবলিকান, যাঁরা আগামী নির্বাচনে বিপদে রয়েছেন। ট্রাম্প তাঁদের বিপদ আরও বাড়িয়ে দিলেন।

জনমতে অগ্রগতি বাইডেনের
বিতর্ক শেষে সিএনএনের তাৎক্ষণিক জনমত জরিপ অনুসারে, ৬০ শতাংশ দর্শক মনে করেন বাইডেন এই বিতর্কে জিতেছেন, ট্রাম্প জিতেছেন এ কথা মনে করেন মাত্র ২৮ শতাংশ মানুষ। ট্রাম্প হেরেছেন বলেই তেমন কিছু না করেও বাইডেন বিজয়ী হয়েছেন। বিতর্কের আগে অনেকের মনে প্রশ্ন ছিল, ৯০ মিনিট ট্রাম্পের আক্রমণ সহ্য করার ক্ষমতা বা এনার্জি বাইডেনের রয়েছে কি না। এই বিতর্কের পর সেই সন্দেহ তিনি অবান্তর প্রমাণ করেছেন। বাইডেনের জন্য সেটাই আসল জয়।

এমন বিতর্ক কেবল অর্থহীন তাই নয়, মার্কিন গণতন্ত্রের জন্য ক্ষতিকর, এই যুক্তিতে কেউ কেউ বাইডেনকে পরবর্তী বিতর্কে অংশ না নিতে পরামর্শ দিয়েছেন। বাইডেনের রানিং মেট কমলা হ্যারিস অবশ্য তেমন দাবি এককথায় বাতিল করে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের কাছে নিজের কথা তুলে ধরার জন্য বাইডেন সর্বদা প্রস্তুত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *