জার্মান সাইকোঅ্যানালিস্ট ও সমাজবিজ্ঞানী এরিক ফ্রম প্রেমকে একটি কলা হিসেবে দেখেছেন এবং ‘প্রেম: দার্শনিক বিচার’ বইটিতে এর পক্ষে বিশাল ব্যাখ্যাও দিয়েছেন। বইটি পড়তে গিয়ে ভীষণ অজানা জেগে উঠল। লেখক কাকে বলে? কিভাবে লিখতে হয়। লেখার উপাদান বা কি হওয়া উচিত। মনেহল আমি এখনও শিশু।
বইমেলা, বই প্রকাশ, লেখনি, মন-মনন এইসব নিয়ে গতকয়েকদিন আগে গভীররাত পর্যন্ত বাসায় আড্ডা হল প্রিয়বন্ধু পুলিশ বিভাগের সাহসী বিনয়ী কর্মকর্তা Parvez Ahmed-এর সাথে। গেল বইমেলায় আমার একটি বই প্রকাশিত হওয়ার পথে ছিল। কেন জানি ভাবছিলাম বইটিতে আরো বহুবিষয় বাদ পড়েছে। আমার অনেক সীমাবদ্ধতা রয়ে গেছে॥ এটি ভাবতে গিয়ে প্রকাশের অনুমতি দেয়া সম্ভব হয়নি। ভাগ্যভাল যে, প্রকাশের আগেই এরিক ফ্রম-এর বইটি পড়ার সুযোগ হয়েছে। অন্যথায় লেখালেখি আসলে নষ্ট হতে পারত।
-এরিক ফ্রমের মতে, অধিকাংশ লোকের কাছে প্রেমের প্রশ্নটি মূলত প্রেম পাওয়ার প্রশ্ন—দেওয়ার প্রশ্ন নয়। সেই জন্য তাদের সমস্যা, কিরূপে প্রেম পাওয়া যায়, কিরূপে প্রেম পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করা যায়। আর এই উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য তারা নানারকম পথও অবলম্বন করে থাকে।
-পুরুষের ক্ষেত্রে প্রেম
-এক্ষেত্রে—প্রেম পাওয়ার জন্য পুরুষেরা মূলত সামাজিক প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা অনুযায়ী কৃতিত্ব ও সফলতা অর্জন করে। প্রতিপত্তি ও ধনসম্পদ অর্জনকে তারা প্রেম পাওয়ার উপায় হিসেবে মনে করে। বিশেষত আমাদের মত দেশ গুলোতে। একদম ন্যায় কথা।
-নারীর ক্ষেত্রে প্রেম
-অন্যদিকে নারীরা দেহ ও পরিচ্ছদের চর্চার মাধ্যমে নিজেদের আকর্ষণীয় করে তোলে। এগুলো ছাড়াও আরও অনেক পথ আছে সেগুলো নারী ও পুরুষ উভয়েই অবলম্বন করে। সেগুলোর মধ্যে আছে শিষ্ট ও ভদ্র আদব কায়দা, মনোজ্ঞ কথোপকথন, নম্র ও মিষ্ট আচরণ।
-এরিক মনে করেন, যেহেতু প্রেমের প্রবৃত্তি বর্জন করা সম্ভব না, সেজন্য এই ব্যর্থতা থেকে বাঁচার একটাই উপায়—এই ব্যর্থতার কারণগুলো অনুসন্ধান করে প্রেমের অর্থ অনুধাবন করা। এর প্রথম পদক্ষেপ হলো—এটা বোঝা যে, প্রেম হলো একটি কলাবিশেষ। যেমন প্রকৃতভাবে বেঁচে থাকাও একটি কলা বা অনুশীলন। অন্য যেকেনো কলা যেমন সঙ্গীত, চিত্রবিদ্যা, চিকিৎসা বিদ্যা, যন্ত্রবিদ্যা শিখতে হলে যেভাবে অনুশীলন করা প্রয়োজন, প্রেমের ক্ষেত্রেও সেইভাবে অগ্রসর হওয়া প্রয়োজন।
-প্রেমে পড়ার প্রয়োজনীয়তার কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেছেন, মানুষের গভীরতম চাহিদা হলো তার বিচ্ছিন্নতাবোধের অবসান, তার একাকিত্বের বন্দিশালা থেকে মুক্তি। সব যুগের এবং সব সংস্কৃতির মানুষ এই একটি প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে প্রেচেষ্ট—কী করে বিচ্ছিন্নতা জয় করা যায়, কী করে মিলন সাধন করা যায়। নিজের ব্যক্তিকেন্দ্রিক জীবন অতিক্রম করে ঐক্য সাধন করা যায়। আদিম গুহাবাসী মানুষ, মিশরের কৃষক, মেষপালক যাযাবর, ফিনিশীয়, জাপানি বা আধুনিক কেরানি সবার ক্ষেত্রেই প্রশ্নটি এক। একই সাধনা। একই অংশগ্রহণ।
নিঃসঙ্গতা বোধ জয় করতে মানুষ নানা ধরনের চেষ্টাও করে থাকে, সেগুলোকে মোটা দাগে তিনটি ভাগে ভাগ করেছেন এরিক।
ক. প্রথম উপায় হিসেবে বলেছেন, অনেকে মাদকতাজনিত বিভোর অবস্থায় থেকে মুক্তির পথ খোঁজে। তবে বিভোর অবস্থা কাটার পর তাদের নিঃসঙ্গতা আরও বেড়ে যায়। এর ফলে তাদের মাদক সেবনের পরিমাণও বেড়ে চলে।
খ. দ্বিতীয় উপায় হিসেবে অনেকে মৈথুন কর্মের উল্লাসের মধ্যে এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজে। তাদের অবস্থা একটু ভিন্ন রকম হয়। এই প্রক্রিয়াকে স্বাভাবিক ও সুস্থ উপায় বললেও এটাকে সমস্যার আংশিক সমাধান হিসেবে চিহ্নিত করেছেন তিনি। তবে অনেকের ক্ষেত্রে এগুলোতে নিঃসঙ্গতা না কমে বরং অভ্যাসে পরিণত হতে পারে।
গ. মিলন লাভের তৃতীয় উপায় হিসেবে এরিক ফ্রম সৃজনশীল কাজের কথা উল্লেখ করেছেন। এটা শিল্পীর কাজও হতে পারে, আবার কারিগরের কাজও হতে পারে। কাঠমিস্ত্রী একটি টেবিল বানানোর সময়, স্বর্ণকার একটি অলঙ্কার বানানোর সময়, চিত্রকর তার ছবি আঁকার সময় বা কৃষক তার শস্য উৎপাদনের সময় সমগ্র বিশ্বের সঙ্গেই মিলিত হয়। এ ধরনের মিলন কেবল উৎপাদনকারী বা সৃজনশীল কাজের মাধ্যমেই সম্ভব। যা আমরা করি না। একটি প্রবন্ধ লিখে পত্রিকায় ছাপিয়ে চারদিকে হৈ চৈ ফেলে দিতে চাই। এতটা সহজে বহুকিছু পাওয়ার এমন বাসনা না থাকাই সঠিক প্রেম।
-এরিকের মতে, অন্য আরেক ব্যক্তির সঙ্গে প্রেমের মিলনে আবদ্ধ হওয়ার চেয়ে আর কোনো বড় আকাঙক্ষা মানুষের মধ্যে নেই। এটাই মানুষের আদিমতম ক্ষুধা। এটাই মনুষ্যজাতিকে, সম্প্রদায়কে, পরিবার ও সমাজকে একত্রে বেঁধে রেখেছে।
-প্রেমকে তিনি দেখিয়েছেন একটি কতৃত্ববাচক ক্রিয়া হিসেবে। যেটি মানুষের একটি শুদ্ধ শক্তির ব্যবহার। সেখানে ‘প্রেম ধরে রাখা’ আসল জিনিস, ‘প্রেমে পড়া’ না।
-প্রেমের ক্ষেত্রে দান ছাড়াও আরও কতগুলো উপাদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সেগুলোর মধ্যে আছে, যত্নশীলতা, দায়িত্ববোধ, শ্রদ্ধা ও জ্ঞান।
-বয়স ও মানসিক অবস্থা ভেদে প্রেমের ক্ষেত্রে কয়েকটা নীতির কথাও উল্লেখ করেছেন এরিক ফ্রম। যেমন-
০১। শিশুসুলভ প্রেমের নীতি হলো, ‘যেহেতু আমি ভালোবাসা পাই, তাই আমি ভালোবাসি’
০২। অপরিণত প্রেমের নীতি হচ্ছে, ‘যেহেতু তোমাকে আমার প্রয়োজন, তাই তোমাকে ভালোবাসি’
০৩। আর পরিণত প্রেম বলে, ‘যেহেতু ভালোবাসি, তাই তোমাকে আমার প্রয়োজন’।
-প্রেম ও সংঘাতের বিষয়ে এরিক ফ্রম বলেছেন, একটি মূঢ় ধারণা আছে যে—প্রেমের সম্পর্কে কখনো কোনো সংঘাত ঘটতে পারে না। লোকে যেমন ভেবে থাকে জীবনে দুঃখ ও বিষাদের ভাগ একেবারেই থাকা উচিত নয়, তেমনি তাদের বিশ্বাস, বিবাদও অনুচিত। তারা এ ধরনের যুক্তির সমর্থন পায় মূলত দৈনন্দিন জীবনের ঘটনাগুলো দেখে। তারা দেখে প্রেমবদ্ধ অবস্থায় যে কলহ হয় তার পরিণতি ধ্বংসাত্মক।
-সবশেষে এরিক আবারও বলেছেন, প্রেম যেহেতু একটা কলা, তাই এর সাধনার ব্যাপারটিও খুব সহজ নয়। একমাত্র চর্চার মাধ্যমেই কোনো কলা শেখা যায়। তবে যেকোনো কলা শেখার জন্য প্রথমে শৃঙ্খলাবোধ দরকার। অনেকে মনে করেন, কী করে ভালোবাসা যায়, তার কৌশল শেখা যায়। এরূপ ধারণাকারীদের ভাগ্যে হতাশা অনিবার্য। প্রেম বা ভালোবাসা একটি নিতান্ত ব্যক্তিগত অনুভব; প্রত্যেক ব্যক্তির ক্ষেত্রে এই অনুভবের জন্ম ব্যক্তির অন্তঃস্থল থেকে এবং এর স্পর্শ এবং স্বাদ ব্যক্তির একান্ত নিজস্ব।
-আমরা বা আমাদের প্রেক্ষাপটে প্রেম হয় আজকাল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কারণে। যারফলে অচেনা অজানার পথে আমরা পথ বা হাত বাড়াই। আজকাল আর শিরি বা ফরহাদের প্রেম চোখে পড়ে না। লায়লি আর মজনুও না।
এক ধরনের সময় অতিক্রম করাই প্রেম হয়ে উঠেছে। কেউ সামান্য সুন্দর বাক্য দিতে পারলে, জানা বুঝা ছাড়াই ঘটছে নানা যোগাযোগ॥ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে এই প্রেম কতটা বিশৃঙ্খলা তৈরী করছে ব্যক্তিতে-ব্যক্তিতে, পরিবার বা সমাজে সেটি অনেকেই অন্তরে ধারণ করে, মননে ক্ষোভ নিয়ে দিনাতিপাত করে চলেছে। এরিক মনে করেন, এই প্রেম বাস্তবতার নিরিখে নয়-কল্পনাপ্রসূত। তাই লেখনি, চলনে-বলনে প্রকৃত প্রেম ছড়িয়ে পড়ুক। সবখানে সর্বত্রই নিরবে ভালোবাসারই জয় হউক।
ডক্টর মুহাম্মদ কামাল উদ্দিন
১৯ মার্চ ২০২২।। শনিবার।