অন্যান্য বছরের মতো বিদায়ী ২০২০ সালটিও শুরু হয়েছিল নতুন কিছুর প্রত্যাশা নিয়ে। কিন্তু বছরের শুরুতেই আঘাত হানল করোনাভাইরাসের মহামারি। এর জেরে দেশে দেশে লকডাউন, কোথাও চলাচলের ওপর বিধিনিষেধে জনজীবন গেল থমকে। অর্থনৈতিক মন্দায় দেউলিয়া হলো অনেক ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান। বেকার হয়ে পড়ল বহু মানুষ। তবে এর চেয়েও ভয়াবহ বিষয়টি হলো, করোনায় আক্রান্ত হয়ে প্রাণ গেছে লাখ লাখ মানুষের।

আধুনিক যুগে কোনো একক সংকট এভাবে পুরো বিশ্বকে বিপর্যস্ত করার নজির নেই। যোগযোগব্যবস্থা এত উন্নতির এ যুগে এসেও পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল দেশগুলো। অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে একেকটি দেশ যেন একেকটি মহাদেশ। মহামারির এক বছর পার হতে চললেও এখনো স্বাভাবিক হলে না কোনো কিছু, বরং দিনে দিনে সংক্রমণ ও মৃত্যুর ঊর্ধ্বগতি চোখ রাঙাচ্ছে।

চীনের উহান থেকে ২০২০ সালের একেবারে শুরুতেই বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে করোনাভাইরাসের মহামারি। করোনাভাইরাসের সার্বক্ষণিক তথ্য প্রকাশ করে যাচ্ছে ওয়ার্ল্ডোমিটারস ডট ইনফো। এই ওয়েবসাইটের তথ্যমতে, গতকাল বুধবার পর্যন্ত বিশ্বজুড়ে ৮ কোটি ২০ লাখের বেশি মানুষের শরীরে করোনার সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। মৃত্যুও গতকাল ১৮ লাখ ছাড়িয়েছে।

করোনার শুরুতে বিভিন্ন দেশের মধ্যে সবচেয়ে কঠোর পদক্ষেপটি নিয়েছিল ইউরোপের দেশ ইতালি। দেশজুড়ে লকডাউন দিয়ে বিশ্বজুড়ে সংবাদ শিরোনাম হয় দেশটি। এর আগে অবশ্য চীন করোনা মহামারির উৎসস্থল উহানসহ পুরো হুবেই প্রদেশ অবরুদ্ধ করে। ঘরবন্দী হয়ে পড়ে কোটি কোটি মানুষ।

ইউরোপে ইতালির পর কঠোর পদক্ষেপ নেয় স্পেন। দেশটি জরুরি অবস্থাও জারি করে। তবে শেষ রক্ষা হয়নি। করোনার প্রথম ঢেউয়ের সময় ইতালি ও স্পেনের স্বাস্থ্যব্যবস্থা আক্ষরিক অর্থেই ভেঙে পড়েছিল। এরপর সংক্রমণ ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়ে যুক্তরাজ্য, জার্মানিসহ ইউরোপের অন্যান্য দেশে। তবে এর মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ব্রাজিলসহ উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন দেশেও সংক্রমণ ছড়াতে শুরু করে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট জইর বলসোনারো প্রকাশ্যে করোনা মহামারিকে উপেক্ষা করেছেন।

করোনায় শুধু সাধারণ মানুষ নন, রথী-মহারথীরাও আক্রান্ত হয়েছেন। বিশ্বের প্রথম সরকারপ্রধান হিসেবে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন করোনা সংক্রমিত হন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট জইর বলসোনারোসহ আরও কয়েকজন সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধান করোনা সংক্রমিত হয়েছেন।
এদিকে করোনা মহামারির শুরু থেকেই একটি কার্যকর ও নিরাপদ টিকা উদ্ভাবনের চেষ্টা চলছে। সেই চেষ্টাই যেন বছরের শেষে এসে আশার আলো দেখিয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২২ ডিসেম্বর পর্যন্ত হালনাগাদ তথ্য অনুসারে, বিশ্বজুড়ে করোনার ২৩৩টি টিকা উদ্ভাবনের কাজ চলছে। এর মধ্যে মানবদেহে পরীক্ষার বিভিন্ন পর্যায়ে রয়েছে ৬১টি টিকা। এসব টিকার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান ফাইজার ও মডার্নার দুটি টিকা, যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান অ্যাস্ট্রাজেনেকার যৌথভাবে উদ্ভাবিত টিকা, রাশিয়ার গামালেয়া রিসার্চ ইনস্টিটিউটের টিকা স্পুতনিক-ভি, চীনের সিনোভ্যাক ও সিনোফার্মের টিকা সবচেয়ে বেশি আলোচনায় রয়েছে।

এরই মধ্যে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, সৌদি আরবসহ বেশ কয়েকটি দেশে করোনার টিকা দেওয়াও শুরু হয়ে গেছে। এ ক্ষেত্রে এগিয়ে রয়েছে ফাইজারের টিকাটি। এই টিকা উদ্ভাবনে সহযোগিতা করেছে জার্মানির জৈবপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান বায়োএনটেক। যুক্তরাজ্য সবার আগে ২ ডিসেম্বর টিকাটির ‍অনুমোদন দেয়। ৮ ডিসেম্বর তা প্রয়োগ শুরু হয় দেশটিতে। এর কয়েক দিনের মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রেও টিকাটির প্রয়োগ শুরু হয়। ইউরোপীয় ইউনিয়নও এই জোটের দেশগুলোয় টিকাটির শর্তসাপেক্ষে বাজারজাত করার অনুমোদন দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে মডার্নার টিকারও অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া যুক্তরাজ্য গতকাল অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকাটির অনুমোদন দিয়েছে।

তবে অভিযোগ উঠেছে, ধনী দেশগুলো টিকা কিনে হুমকিতে ফেলে দিয়েছে দরিদ্র দেশগুলোকে। পিপলস ভ্যাকসিন অ্যালায়েন্স নামের একটি জোট সম্প্রতি জানিয়েছে, ধনী দেশগুলোর মোট জনসংখ্যা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার মাত্র ১৪ শতাংশ। কিন্তু তারা মোট চাহিদার ৫৩ শতাংশ টিকা কিনে রেখেছে। এতে স্বল্প আয়ের প্রায় ৭০টি দেশ তাদের জনগোষ্ঠীর প্রতি ১০ জনে ১ জনকে টিকা দিতে পারবে।
মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, দাতব্য সংস্থা অক্সফামের মতো সংগঠন নিয়ে গড়ে উঠেছে পিপলস ভ্যাকসিন অ্যালায়েন্স জোটের নেটওয়ার্ক। এই জোট বলেছে, মডার্নার উদ্ভাবিত টিকাটির শতভাগ ডোজ কিনে নিয়েছে ধনী দেশগুলো। এসব দেশ ফাইজারের টিকারও ৯০ শতাংশ কিনে ফেলেছে। অ্যাস্ট্রাজেনেকা অবশ্য উন্নয়নশীল বিশ্বেও তাদের টিকা সরবরাহের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের ডিউক ইউনিভার্সিটি, ইউনিসেফ ও বিজ্ঞানবিষয়ক বিশ্লেষক প্রতিষ্ঠান এয়ারফিনিটি বিভিন্ন দেশের টিকা কেনার চুক্তি সংগ্রহ করেছে। এসব চুক্তি বিশ্লেষণ করে সম্প্রতি নিউইয়র্ক টাইমস–এর এক প্রতিবেদনে জানানো হয়, ইউরোপীয় ইউনিয়ন যে পরিমাণ টিকা কিনেছে, তাতে এই জোটের দেশগুলোয় প্রত্যেক মানুষকে দুবার করে টিকা দেওয়া যাবে। যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র প্রত্যেক নাগরিককে দিতে পারবে চার ডোজ করে টিকা। কানাডা যে পরিমাণ টিকা কিনেছে, তাতে দেশটির প্রত্যেক নাগরিককে ছয় ডোজ করে টিকা দেওয়া যাবে।

অবশ্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কোভ্যাক্স কর্মসূচির আওতায় টিকা সংগ্রহের চেষ্টা করছে। সর্বশেষ খবর অনুযায়ী, এই কর্মসূচির আওতায় এ পর্যন্ত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ২০০ কোটি ডোজ টিকা কেনার চুক্তি হয়েছে। সংস্থাটি বলেছে, কোভ্যাক্স কর্মসূচিতে অংশগ্রহণকারী ১৯০টি দেশেই ২০২১ সালের প্রথমার্ধে টিকা সরবরাহ সম্ভব হতে পারে।
নিউইয়র্ক টাইমস জানায়, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালকের জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা ব্রুস আইলওয়ার্ড বলেছেন, ধনী দেশগুলোর টিকা কেনার ধুমের পরিণতি হতে পারে ভয়াবহ। কারণ, তারা নিজেদের পুরো জনগোষ্ঠীর জন্য টিকা কিনে ফেলছে। যে সময় অন্য দেশগুলোয় সংক্রমণের সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকা মানুষগুলোর টিকার তাৎক্ষণিক প্রয়োজন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *