যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মধ্যে ব্যক্তিগত সখ্য রয়েছে। গত বছর সেপ্টেম্বরে তাঁরা দুজন টেক্সাস অঙ্গরাজ্যের হিউস্টনে হাতে হাত মিলিয়ে লাখখানেক ভারতীয়র সামনে হাজির হয়েছেন, ভাষণ দিয়েছেন। ভারতে গিয়ে মোদির নিজের রাজ্য গুজরাটে স্টেডিয়ামভর্তি মানুষের সামনে ভাষণ দিয়ে ট্রাম্পও দুই দেশের ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
এ ছাড়া মার্কিন প্রেসিডেন্ট পাকিস্তানের ব্যাপারে সমালোচনামুখর হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী ভারতীয়দের মধ্যেও জনপ্রিয়। এই প্রবাসীদের আমন্ত্রণে ট্রাম্পের মেয়ে ইভাঙ্কা ট্রাম্প ভার্জিনিয়ায় দীপাবলি উৎসবে যোগ দিয়েছেন। স্বাভাবিকভাবেই ট্রাম্প আশা করবেন, নভেম্বরের নির্বাচনে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত ভারতীয়রা তাঁকেই ভোট দেবেন।
যুক্তরাষ্ট্রে বৈধভাবে বাস করেন, এমন ভারতীয়র সংখ্যা প্রায় ৪০ লাখ। তাঁদের অধিকাংশেরই বাস নিউইয়র্ক, নিউ জার্সি ও ক্যালিফোর্নিয়ার মতো ডেমোক্রেটিক-প্রধান অঙ্গরাজ্যগুলোয়। এসব অঙ্গরাজ্যে এই অভিবাসীদের ভোট প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে খুব একটা প্রভাব ফেলবে না। কিন্তু কংগ্রেস ও সিনেট নির্বাচনে তাঁদের ভোট যথেষ্ট গুরুত্ব বহন করে। তবে উইসকনসিন ও মিশিগানের মতো অঙ্গরাজ্যগুলোর ভোট নির্বাচনের ফলাফল নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। এসব অঙ্গরাজ্যেও উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ভারতীয়র বাস। সে হিসাবে তাঁদের ভোট গুরুত্বপূর্ণ।
ভারতীয়দের মতো বাংলাদেশি-আমেরিকানদেরও প্রধানত ‘নীল’ বা ডেমোক্রেটিক অঙ্গরাজ্যগুলোয় বসবাস। মোট সংখ্যার হিসাবে যা ১ লাখ ৭০ হাজারের মতো।
প্রথাগতভাবে অধিকাংশ দক্ষিণ এশীয় অভিবাসী ডেমোক্রেটিক পার্টির সমর্থক। ২০১২ সালে পিউ সার্ভের এক জরিপের তথ্য অনুসারে, ৬৫ শতাংশ ভারতীয় ডেমোক্রেটিক পার্টির সমর্থক। ২০০৮ সালের নির্বাচনে প্রায় ৮৪ শতাংশ ভারতীয় ডেমোক্রেটিক পার্টির সে সময়ের প্রার্থী বারাক ওবামার পক্ষে ভোট দিয়েছিলেন। ট্রাম্প-মোদির সখ্যের কারণে এই সমর্থনে কিছুটা ভাটা পড়েছে—এতে কোনো সন্দেহ নেই। ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার রাষ্ট্রবিজ্ঞানী কার্তিক রামাকৃষ্ণান সম্প্রতি ভারতীয়দের রাজনৈতিক সংযুক্তি প্রশ্নে একটি সীমিত আকারের জরিপ চালিয়েছেন। তাঁর হিসাব অনুসারে, ৫৪ শতাংশ ভারতীয়-আমেরিকান জো বাইডেনের সমর্থক। ট্রাম্পের সমর্থক, এমন ভারতীয়-আমেরিকানের সংখ্যা ২৯ শতাংশ। বাংলাদেশিদের মধ্যে এ ধরনের কোনো জরিপ হয়নি। তবে ট্রাম্প ও বাইডেনের প্রতি বাংলাদেশিদের সমর্থনের আনুপাতিক হিসাব ভারতীয়দের অনুরূপ বলেই মনে করা হয়। বাইডেনের পক্ষে একাধিক বাংলাদেশি-আমেরিকান গোষ্ঠী কাজও করছে। সম্প্রতি ফিজিতে সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত ওসমান সিদ্দিকের নেতৃত্বে মূলত বাংলাদেশিদের অংশগ্রহণে ‘সাউথ এশিয়ান্স ফর বাইডেন’ নামে একটি গ্রুপ গঠিত হয়েছে।
দক্ষিণ এশীয়, বিশেষত ভারতীয়দের নিজেদের দলে টানতে কয়েক বছর ধরে রিপাবলিকান পার্টি পরিকল্পিত উদ্যোগ নিয়েছে। তাদের এই উদ্যোগে বড় রকমের সহায়ক ছিল জাতীয় পর্যায়ে একাধিক ভারতীয় বংশোদ্ভূত রাজনীতিকের আবির্ভাব। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন লুইজিয়ানার সাবেক গভর্নর ববি জিন্দাল ও সাউথ ক্যারোলাইনার সাবেক গভর্নর নিকি হ্যালি। তবে তাঁদের প্রভাব তেমন বিস্তৃত হয়নি। চলতি ট্রাম্প প্রশাসনেও বেশ কয়েকজন ভারতীয় গুরুত্বপূর্ণ পদে রয়েছেন। অন্যদিকে সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন ও বারাক ওবামার প্রশাসনে তুলনামূলকভাবে বেশিসংখ্যক ভারতীয় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। জাতীয় রাজনীতিতেও ডেমোক্রেটিকপন্থী ভারতীয়দের অংশগ্রহণ অনেক বেশি তাৎপর্যপূর্ণ। সিনেটর কমলা হ্যারিস ছাড়াও চলতি মার্কিন কংগ্রেসে চারজন সদস্য ভারতীয় বংশোদ্ভূত। নভেম্বরের পর এই সংখ্যা আরও বাড়তে পারে।
একাধিক কারণে ভারতীয় ও অন্যান্য দক্ষিণ এশীয়দের মধ্যে ট্রাম্পের ব্যাপারে উৎসাহে ভাটা পড়েছে। অভিবাসন প্রশ্নে ট্রাম্প প্রশাসনের কঠোর অবস্থান এর অন্যতম। সম্প্রতি ট্রাম্প ঘোষণা করেছেন, ফ্যামিলি রিইউনিয়ন বা পারিবারিক পুনর্মিলন কর্মসূচি বাতিল করে মেধাভিত্তিক অভিবাসনব্যবস্থা চালু করবেন তিনি। এর ফলে বিপুলসংখ্যক দক্ষিণ এশীয় অভিবাসী তাঁদের মা–বাবা ও সন্তানদের বাইরে অন্য নিকটাত্মীয়দের যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য আমন্ত্রণ জানাতে সক্ষম হবেন না। বারাক ওবামার আমলে ভারতীয় ও অন্যান্য দক্ষিণ এশীয়দের জন্য প্রযুক্তি ক্ষেত্রে চাকরিপ্রাপ্তির যে সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছিল, ট্রাম্প তাতেও নিয়ন্ত্রণ এনেছেন। ভারতের সঙ্গে অগ্রাধিকারভিত্তিক বাণিজ্যব্যবস্থার একটি কর্মসূচিও ট্রাম্প বাতিল করেছেন।
এরপরও এখনো যাঁরা ট্রাম্পের ব্যাপারে উৎসাহী, কমলা হ্যারিসকে ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী জো বাইডেনের রানিংমেট করায় তাঁরা অবস্থান পরিবর্তন করবেন বলে মনে করা হচ্ছে। অনেক ভারতীয় অবশ্য অভিযোগ করেছেন, কমলা নিজেকে একজন কালো মানুষ হিসেবে উপস্থাপনেই বেশি আগ্রহী। নিজের মায়ের কথা উল্লেখ করা ছাড়া তাঁর ভারতীয় পরিচয় তিনি খুব সামান্যই তুলে ধরেন। এই সমালোচনার মুখে সাম্প্রতিক সময়ে কমলা দুই ভারতীয় অভিনেতা মিন্ডি কালিং ও হাসান মিনহাজের সঙ্গে একাধিক অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছেন।
অধ্যাপক কার্তিক রামাকৃষ্ণান মনে করেন, যেসব দক্ষিণ এশীয়, বিশেষত ভারতীয় ২০১৬ সালে ট্রাম্পের পক্ষে ভোট দিয়েছিলেন, আগামী নির্বাচনে তাঁদের অনেকেই বাইডেনকে সমর্থন করবেন। এর একটা বড় কারণই হলো কমলা হ্যারিস।