করোনা আমাদের বহু কিছু দেখিয়েছে। কিন্তু আমরা ভুলে গেছি। জিনিসপত্রের দাম, নিজেদের মধ্যে হানাহানি। বিবেদ দেখে মনেহয় না গত ১বছর আগে আমরা কতটা অনিরাপদ, কতটা দু.সময় কাটিয়েছি। মানুষ এনমই। সে প্রয়োজনে মনে রাখে-প্রয়োজনে ভুলে যায়। মানুষ এমনই সে তার জন্য করে, তার জন্য ভুলে যায়। আজ লিখব এমন এক বিষয়ে যেখানে মানুষ বার বার ভুলে বা ভুল করে। ব্যক্তিজীবনে ব্যর্থতার মানে, ভুল শুধরানোর সুযোগ।
মনেরেখ পিছিয়ে পড়ার মানে, স্কিল ডেভেলপ করতে উদ্বুদ্ধ করার সুযোগ। ধোঁকা দেয়ার মানে, বিকল্প উপায়ে চেষ্টা করার তাগিদ। পরীক্ষায় পেছনে পড়ার মানে, পড়ালেখায় সিরিয়াস হতে সতর্ক করে দেয়া। চাকরির ইন্টারভিউতে রিজেক্ট হওয়ার মানে, পরের ইন্টারভিউর জন্য ১০০গুন ভালো প্রিপারেশন নিতে প্রস্তুত হওয়া। কোদাল খুঁজে না পাওয়ার মানে, একটু বেশি কষ্ট করে ছুরি বা গাছের ডাল দিয়েও মাটি খোঁড়ার ডেডিকেশন আছে কিনা যাচাই করা। উঠানের গাছ মরে যাওয়ার মানে, পুকুর পাড়ে, খালের পাড়ে-নদীর ধারে চারা লাগাতে উৎসাহ দেয়া।
জীবনের সব কিছুতেই এগুনোর জন্য-পেছাতে হবে। সফল হওয়ার জন্য ব্যর্থ হতে হবে। পাওয়ার জন্য হারাতে হবে। পিছিয়ে পড়ার মানেই, নিঃশেষ হয়ে যাওয়া নয়। প্রিয়জন ছেড়ে যাওয়ার মানেই, বেঁচে থাকাটা মূল্যহীন হয়ে যাওয়া নয়। এক দরজা থেকে ফিরিয়ে দেয়ার মানেই, সব দরজা বন্ধ হয়ে যাওয়া নয়। কারণ, জীবনের খেলায় কেউ দু-চার দিনে অল-আউট হয় না। লাইফের টিভি সিরিয়াল, আট-দশটা এপিসোড হয়েই বন্ধ হয়ে যায় না। এক সাবজেক্ট বা এক সেমিস্টারের রেজাল্ট দিয়ে অনার্স-মাস্টার্সের ওভারঅল সিজিপিএ নির্ধারিত হয় না। হয় কি? কিন্তু আমরা তা বুঝি না।
জীবনের যেসকল সমস্যাকে আমরা সামনে আনতে চাই প্রকৃতপক্ষে সেই গুলো সমস্যা না। সমস্যা হল-হেরে যাওয়া। জীবনে ধোঁকা খাওয়া, বোকা হওয়া-সমস্যা না। পরীক্ষার লাড্ডু পাওয়া, ছ্যাঁকা খাওয়াও-সমস্যা না। সমস্যা হচ্ছে-সাময়িক ব্যর্থতা দেখে দমে যাওয়া। আশানুরূপ ফল না দেখে, রাস্তা ছেড়ে দেওয়া। ক্লান্ত হয়ে লক্ষ্য ভুলে যাওয়া। দৌঁড়ে যে প্রথম হচ্ছে তার সাথে নিজেকে তুলনা করে হতাশ হয়ো না বরং তুমি দৌড়ে ১০ম হলে তোমার কম্পিটিশন হবে ৯ম এর সাথে। তাকে পিছনে ফেলতে পারলে ৮ম এর সাথে টেক্কা দিবে। এইভাবে এক এক করে সামনে এগুতে পারলে, যখন প্রথম তিন-চার জনে আসবে তখন ১ম জনের সাথে নিজেকে তুলনা করো। এটাই হবে তোমার কাজ। একতলার খবর না নিয়ে বহুতলে উঠার যে প্রবণতা তা তোমাকে হেরে দিবে। বিজয়ে এটাই বড় বাঁধা।
বোকারা শুনো! কতরকম বিপদ, গ্লানি আসবে জান? জান না। তোমার বাসায়, পকেটের টাকায়, মনের জানালায় হাজারটা সমস্যা থাকতে পারে। রাতের গরমে, ছারপোকার কামড়ে তোমার জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠতে পারে। তোমার বন্ধুদের প্রেমিকাসহ ফুচকা খাওয়ার ছবি দেখে তোমার অন্তর হাহাকার করে উঠতে পারে। তবে আজকের দিনটা চলে গেলে, ক্যালেন্ডারের পাতাটা উল্টে গেলে, পাওয়া-না পাওয়ার হিসেব কিন্তু চূড়ান্ত হয়ে যাবে। জীবন বেশি উপভোগ করতে গিয়ে, অনুশোচনা করো না।
এক্সট্রা মজা নিতে গিয়ে, এক্সট্রা সাজা জুটিয়ে ফেলো না। আনন্দ আর ইফোর্ট এর মধ্যে ব্যালেন্স রেখো। একদিন রিলাক্স করে, আড্ডা মেরে, ছয়দিন ফুল স্পিডে কাজ করার এনার্জি সঞ্চয় করো। লেগে থাকো। দেখবে, শত শত লাত্থি উষ্ঠা খেয়েও ঠিকই ঘুরে দাঁড়িয়ে গেছো। হয়ত এটার নাম জীবন।
জীবনকে যদি ঠিক তার জায়গায় নিতে চাই আজই কাজে নেমে পড়। ভেঙ্গে যাওয়া ব্রিজ ঠিক হওয়ার আশায় বসে থাকলে, দিন চলে যাবে, গন্তব্য কাছে আসবে না। প্রশ্ন সোজা হওয়ার ভরসায় সময় অপচয় করলে, টেনেটুনে পাশ হয়ে যাবে, স্কিল ডেভেলপ হবে না। চাকরির বাজার ভালো হওয়ার জন্য অপেক্ষা করলে, বাসা ভাড়ার বকেয়া বাড়তে থাকবে, অফার লেটার হাতে আসবে না। এভাবে দিন চলে যাবে, দেনা বাড়বে। তুমি ভীষণ পেছনে পড়বে, কেউ ফিরেও তাকাবে না।
তাই একটি পথ বন্ধ হলে, এক রাস্তার ব্রিজ নষ্ট হলে, অন্য রাস্তা দিয়ে যাবে। এক বাস নষ্ট হলে অন্য বাসে উঠবে। রিক্সার স্পিড বাড়াতে না পারলে, টেম্পু খুঁজবে। কর্তৃপক্ষের পলিসি চেইঞ্জ করাতে না পারলে, তোমার স্ট্রাটেজি চেইঞ্জ করবে। তারপরেও অন্যের আশায় বসে থাকবে না। অন্যকে চেইঞ্জ করতে গিয়ে সময় নষ্ট করবে না-বরং তোমার এক্টিভিটিস চেইঞ্জ করবে। পারবে তো? হয়ত পারবে। তবে পারতে হবে।
শুনো জীবনের গল্প এমনই। সব পরিবর্তন হবে। কেউ বসে থাকবে না। ক্লাস সিক্স থেকে উপরের ক্লাসে উঠতে গেলে, আগের ক্লাসের বইয়ের মায়া ছাড়তে হবে। একইভাবে নতুন কিছু করতে হলে, নিজেকে আপগ্রেড করতে চাইলে, আগের লেভেলের আরামের কথা, পুরাতন হতাশার কথা, মাথা থেকে ডিলিট মারতে হবে। জ্যামের মধ্যে যে বাসে বসে আছো সেই বাসের মায়া ছাড়তে না পারলে, সামনের বাসে গিয়ে উঠার আনন্দ পেতে পারবে না। পড়া বুঝতে না পারার হতাশাকে আগলে ধরে বইখাতা না খুললে, কোনদিনও পড়া বুঝতে পারবে না। কোনদিনও ভালোভাবে পাশ করতে পারবে না। এটাই বাস্তবতা। এটাই জীবন।
তবে এক লাফে আসমানে উঠার স্বপ্ন দেখো না। দু-চারদিন প্রাকটিস করে বিশ্ব জয় করার আশা করলে, হতাশার সমুদ্র নিয়ে ফিরার সম্ভাবনা বেশি। বরং হারতে হারতে শরীরের শেষ রক্ত বিন্দু দিয়েও লেগে থাকার ইচ্ছা নিয়ে নামতে পারলে কিছু হবার সম্ভাবনা থাকবে। কারণ স্ট্রাগলের খনি তৈরি করতে পারলেই, আগ্নেয়গিরির উত্তপ্ত লাভা হিসেবে বেরিয়ে আসতে পারবে। সফলতার চারাগাছ দেখার আগেই, চেষ্টার বীজ বুনতে পারলেই, মাঠ ভরা ফসল গুদামে ভর্তি করতে পারবে। নিঃশেষ হওয়ার ইচ্ছা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারলেই, আত্মবিশ্বাস নিয়ে ফিরে আসতে পারবে। তখন টিটকারি মারা বন্ধুরাও তোমাকে অভিবাদন দিতে লাইনে দাঁড়াবে। এটাই পৃথিবী এটাই সমাজ। এটাই পরিবার আর এটাই নিয়ম।
রবীন্দ্রনাথ স্কুল থেকে পালিয়েছেন, নজরুল পড়তেই পারলেন না, লালন বুঝলইনা স্কুলটা কি? আজ তাঁদের নিয়ে মানুষ গবেষণা করে তাদের লেখা নিয়ে পিএইচডি করে। আন্ড্রু কার্নেগিকে ময়লা কাপড় পরিধানের জন্য পার্কে ডুকতে দেননি। ৩০ বছর পর সেই পার্কটি তিনি কিনে ফেলেন তার তাতে লাগিয়ে দেন ‘সবার জন্য উন্মুক্ত।’স্টিভ জবস প্রতি রোববার ভালো খাবারের আশায় ৭ মাইল দুরে পায়ে হেঁটে ইসকন মন্দিরে যেতেন।
ভারতের সংবিধান প্রণেতা আম্বেদকর নিম্ন বর্ণের হিন্দু ছিলেন বলে স্কুলে বারান্দায় বসে ক্লাস করতেন, কোন গাড়ি তাকে নিতেন না, মাইলের পরম মাইল পায়ে হেঁটে তিনি পরীক্ষা দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী মোধি চা বিক্রয় করতেন। বাংলাদেশ ব্যাংকে গভর্ণর আতিয়ার রহমান বাজার থেকে চাঁদা তুলে পড়ালেখা করেছেন। ৫টাকা ধার নিয়ে ফরম ফিলাপ করেছেন সেই ধার এখনও শোধ করতে পারেননি। গরু না থাকায় তিনি নিজে জমিতে লাঙ্গল টেনেছেন।
একটি অজোপাড়া গাঁয়ের ছেলে ড. ইউনূস শান্তির জন্য নোবেল পেয়েছেন। আমাদের জাতিকে সন্মানিত করেছেন। সুন্দর চেহারার কথা ভাবছেন? শেখ সাদীর চেহারা যথেষ্ট কদাকার ছিল। হযরত বেলাল ছিলেন হাবসি। বেলালের আজান আল্লার আরস পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল। লতা মুঙ্গেস্কারের চেহারা মোটেই সুশ্রী ছিল না। তৈমুর লং খোড়া ছিলেন, নেপোলিয়ন বেটে ছিলেন। আব্রাহাম লিংকন’র মুখ ও হাত যথেষ্ট বড় ছিল। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এরিষ্টটল ছিলেন তোতলা ।
স্মৃতিশক্তির কথা ভাবছেন? আইনস্টাইন নিজের বাড়ির ঠিকানা ও ফোন নম্বর মনে রাখতে পারতেন না। কোন শক্তিই আপনার উন্নতির জন্য বাধা হতে পারে না যদি আপনি উদ্যোগী হন। বরং মনে রাখবেন যতই করে আপনার উন্নতির জন্য আপনি নিজেই বড় বাধা। নিজের চিন্তা, ধ্যান ধারনা নিজের জন্য বাধা। আপনার নিজের ভিতরের ভয়কে জয় করুন।
আমাদের আছে বিশ্বের ১নম্বর সমুদ্র সৈকত, আছে বিশ্বের সপ্তম আশ্চার্য সুন্দরবন, বিশ্বের ১১তম সেতু আছে, আছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। ভাষার জন্য যুদ্ধ করার একমাত্র গৌরব। শান্তির জন্য নোবেল পাওয়ার গৌরব, স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস, ৭ই মার্চের ভাষণের মধ্য দিয়ে একটি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার গর্বিত ইতিহাস, আমাদের আছে সাকিব আল হাসান, মাশরাফির মত বিশ্বসেরা মানুষ। আমাদের রয়েছে হিমালয় বিজয়ের ইতিহাস।
আমাদের মেয়েরা আজ বিশ্বের অনেক রাষ্ট্রের এমপি, মন্ত্রী হচ্ছেন। বিশ্বের অনেক গুলো দেশের কাছাকাছি আমরা। আমাদের বেঁচে থাকতে হবে পথ হারাদের পথ দেখানোর জন্য, একমাত্র শিক্ষার আলো দিয়েই সেই পথ আবিস্কার করা যাবে। টাইমলাইনের শত শত ছবিতে লাইক না দিয়ে-দিনে একটি ছবিতে কমেন্ট করবে। একটি লিখাতে লাইক দিবে বা নিজের মতামত তুলে ধরবে। নিজে আলোকিত হবে-দেশটাকে আলোকিত করবে। বিশ্বাস পারবে। কারণ যারা পেরেছে তারও তোমার মতই। ব্যবধান তুমি হতাশ হও-সে হতাশা থেকে শিখে।
ডক্টর মুহাম্মদ কামাল উদ্দিন
১২ মার্চ ২০২২।। শনিবার