মো. রবিন পাঁচ বছর ধরে ঢাকার মিটফোর্ড এলাকার বিল্লাল শাহ মার্কেটে ওষুধের পাইকারি ব্যবসা করছেন। ওই মার্কেটের ব্যবসায়ীদের মধ্যে তিনি বেশ জনপ্রিয়। এখন তিনি মার্কেটের দোকান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক। কিন্তু তিনি যে সারা দেশে নকল ও ভেজাল ওষুধ ছড়িয়ে দেওয়ার সঙ্গে যুক্ত, একথা জানা ছিল না ব্যবসায়ীদের।
একাধিক ব্যবসায়ীর ভাষ্য, পাঁচ বছর ব্যবসা করেই প্রভাবশালী হয়ে উঠেছিলেন তিনি। তাঁর উত্থান নিয়ে কানাঘুষাও চলছিল।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) তদন্ত করে বলছে, রবিন দেশের জেলা এবং উপজেলায় জীবন রক্ষাকারী ওষুধসহ বিভিন্ন ধরনের ভেজাল ওষুধ ছড়িয়ে দিচ্ছেন। এমন অভিযোগে গত ১২ জুলাই তাঁকেসহ চক্রের ৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে ফয়সাল হোসেন নামের এক ওষুধ ব্যবসায়ীও রয়েছেন। শুধু এই দুজন নন, এই চক্রে আরও কয়েকজন ওষুধ ব্যবসায়ী জড়িত রয়েছেন বলে তথ্যপ্রমাণ পাওয়া গেছে।
অভিযানে এই চক্রের সদস্যদের কাছ থেকে বিভিন্ন নামী ব্র্যান্ডের জীবন রক্ষাকারী ওষুধসহ বহুল প্রচলিত ওষুধ উদ্ধার করা হয়েছে। গ্রেপ্তার অন্য ছয়জন হলেন নাসির উদ্দিন, মো. ওহিদুল, মামুন কারাল, আবু নাঈম, মো. ইব্রাহিম ও ফয়সাল মোবারক।
ডিবির কর্মকর্তারা জানান, সাভার, পিরোজপুর ও নীলফামারীতে চারটি কারখানায় এসব ভেজাল ওষুধ তৈরি করা হয়। এগুলোর মধ্যে সাভার ও পিরোজপুরের দুটি কারখানায় অভিযান চালানো হয়েছে। কারখানা দুটির মালিক ফয়সাল মোবারক। তিনি ইউনানি ব্যবসার লাইসেন্স নিয়ে ভেজাল ওষুধ তৈরি করছিলেন। অন্য দুটি কারখানার মধ্যে একটির মালিক চক্রের প্রধান ইমরানুল ইসলাম ওয়াহিদ। অন্য কারখানার অবস্থান নীলফামারীর সৈয়দপুরে। আতিয়ার নামের এক কেমিস্ট ওই কারখানার মালিক। তাঁর দেওয়া ফর্মুলাতেই চারটি কারখানায় নকল ওষুধ তৈরি হয়। চক্রের প্রধান ইমরানুল এবং কেমিস্ট আতিয়ার এখনো গ্রেপ্তার হননি।
ডিবির লালবাগ বিভাগের কোতোয়ালি জোনের অতিরিক্ত উপকমিশনার সাইফুর রহমান আজাদ প্রথম আলোকে বলেন, চক্রের সদস্যরা পুরান ঢাকার ধোলাইখাল এলাকায় অর্ডার দিয়ে নকল ওষুধের সরঞ্জামাদি তৈরি করেছেন। চক্রের অন্যতম সদস্য গ্রেপ্তার আবু নাঈম নকল ওষুধের মোড়কের কাজ ও লেবেলিং করতেন। তাঁরা কাজটি এত নিখুঁতভাবে করছিলেন যে সাধারণ মানুষ দেখে বুঝতেই পারবেন না, এটি নকল কি না। এই চক্রের প্রধানসহ (ইমরানুল ইসলাম ওয়াহিদ) কয়েকজন পলাতক রয়েছেন।
ডিবি জানায়, এই চক্রে আরও কয়েকজন ওষুধ ব্যবসায়ীর নাম এসেছে। কয়েকজনকে গ্রেপ্তারের পর ওষুধ ব্যবসায়ী কালাম, পাবেল ও সোহাগ আত্মগোপনে আছেন।
বাংলাদেশ কেমিস্টস অ্যান্ড ড্রাগিস্টস সমিতির সভাপতি (কমিটির মেয়াদোত্তীর্ণ) সাদেকুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘দেশে বিভিন্ন নামী প্রতিষ্ঠানের ওষুধ নকল হচ্ছে। অনেক অসাধু ব্যবসায়ী এগুলো বিক্রির সঙ্গে জড়িত। বিভিন্ন সময় আমরা নকল ওষুধ ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছি। কোনো কোনো প্রভাবশালী ব্যবসায়ী এখনো এ ধরনের ব্যবসা করছেন।
মুখ খুলতে চান না ব্যবসায়ীরা
মিটফোর্ড এলাকায় ঘুরে জানা গেছে, আরও কয়েকটি চক্র নকল ওষুধ ছড়িয়ে দিচ্ছে। বিভিন্ন সময় নকল ওষুধ বিক্রির দায়ে অনেক ওষুধ ব্যবসায়ীকে জেল-জরিমানা করেছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। তারপরও এসব চক্রের দৌরাত্ম্য থামছে না। এ বিষয়ে প্রকাশ্যে কেউ মুখ খুলতে চান না।
সরদার মেডিসিন মার্কেটের এক ব্যবসায়ী জানান, ডিবির হাতে গ্রেপ্তার চক্রটির প্রধান ইমরানুল ইসলামকে প্রকাশ্যে দেখা যায় না। তিনি কখনোই ওষুধ ব্যবসার সঙ্গে ছিলেন না। তবে স্থানীয় হওয়ার কারণে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক ছিল। এই সুবাদে ভেজাল ওষুধ ক্রয়-বিক্রয়ের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। তাঁর বিরুদ্ধে কথা বললে এখানে ব্যবসা করা সম্ভব নয়।
সরদার মেডিসিন মার্কেটের ওষুধ ব্যবসায়ী মালিক সমিতির সভাপতি ফারুক আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, নকল, ভেজাল ও মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ কোনোভাবেই বিক্রি করা যাবে না। এ–সংক্রান্ত জরুরি সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে। ব্যবসায়ীরা এ ধরনের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত হবে না মর্মে স্বাক্ষরও করেছেন। তাই এমন কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের বিষয়ে সমিতি দায়দায়িত্ব নেবে না।
চক্রের প্রধান ইমরানুলের বিষয়ে জানতে চাইলে ফারুক আহমেদ বলেন, ইমরানুলকে তিনি চেনেন না। এ বিষয়ে কিছু বলতে পারবেন না।
ব্যবসায়ীরা জানান, মিটফোর্ড হাসপাতাল ঘিরে ওই এলাকায় দেড় শ বছর আগে ওষুধের পাইকারি বাজার গড়ে ওঠে। একসময় সারা দেশের ওষুধ ব্যবসায়ীরা মিটফোর্ড থেকে পাইকারি দরে ওষুধ ক্রয় করতেন। পরবর্তী সময়ে ওষুধ কোম্পানিগুলো নিজেদের প্রতিনিধির মাধ্যমে ওষুধ বিক্রি করার কারণে এই মার্কেটের জৌলুশ আর আগের মতো নেই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক আ ব ম ফারুক প্রথম আলোকে বলেন, নকল ও ভেজাল ওষুধ তৈরি এবং বিপণনের সঙ্গে জড়িতরা গণহত্যার মতো অপরাধ করছে। না জেনে ওষুধ খেয়ে অনেকেই মারা যাচ্ছেন। যাঁরা এগুলো তদারক করার দায়িত্বে আছেন, তাঁরাও সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করছেন না। জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকির জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা না নিলে এগুলো বন্ধ করা যাবে না।