ডক্টর মুহাম্মদ কামাল উদ্দিন
২০ ফেব্রুয়ারি।। ২০২২।। রোববার।।
একটি স্ট্যাডি দিয়ে শুরু করি-
ষ্ট্যাডি-১ : আমার পরিচিত এক রিক্সাচালক। নিয়মিতই রিক্সাভ্রমনে বা ছোট কাজকর্মে তাকে ডাকি। তার সাথেই বের হই। একদিন রাত আনুমানিক ১টা হবে আমি শহরের বাইরে থেকে আসছি। বাসার খুব কাছাকাছি এসে দেখি সে একটি ফ্যাক্টরীর সামনে দাঁড়িয়ে আছে ড্রেস পরা। আমি নেমে জানতে চাইলাম সে রিক্সা চালানো কি ছেড়ে দিয়েছে, বলল!! না। তাহলে? উত্তরে বলল-দিনে রিক্সা চালান আর রাতে এই প্রতিষ্ঠানের দারোয়ানের কাজ করেন-
ষ্ট্যাডি-২ : করোনা শুরুর পর থেকে নানা কারণে ভাবলাম গাড়ি চালানো শিখি। শুরু হল চালক হওয়ার পর্ব। প্রায় সময় ফজরের পর গাড়ি নিয়ে বের হতাম। একদিন সকাল ৭টায় দেখি একই লোক আবাসিক এলাকার গেইটে শীতের পিঠা বানিয়ে বিক্রি করছে। এবার আমি একটু অবাক হলাম। বললাম আজ বাজারে যাব ১০টায় রিক্সা নিয়ে আসেন চাচা। যথাসময়ে চাচা আসলেন, বের হলাম। পথে চাচার কাছে জানতে চাইলাম, আপনি রিক্সা চালান, রাতে দারোয়ানের কাজ করেন, সকালে পিঠা বিক্রি করেন। এত কাজ কেন, ঘুমান বা কখন?
ষ্ট্যাডি-৩ : চাচা শুরু করলেন। তাঁর ছেলের নাম আনিস। সে এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ ৫ পেয়েছে। এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। তাতেও জিপিএ ৫ পাবে। একটা ভালো কোচিং এ ভর্তি করাতে হবে তাই এত পরিশ্রম করছেন যাতে মেডিক্যালে ভর্তি হতে পারে। কোচিং এ অনেক টাকা লাগবে। আমি বললাম তার পরীক্ষা শেষে আমার সাথে যোগাযোগ করাবেন, আমি দেখি কোন সহায়তা দিতে পারি কিনা। চাচা মহা খুশি। বললেন আমি মনে মনে স্থির করে রেখেছিলাম আপনাকে বলব। কিন্তু সাহস করিনি। কারণ আপনি তো সবসময় সাহায্য করেন।
ষ্ট্যাডি-৪ : পরীক্ষা শেষ কোচিং এ ভর্তি করালাম। ছেলে এইচএসসি পাস করল। মেডিক্যালে ভর্তিও হল। গত কয়েকদিন আগে চাচার সাথে দেখা চাচা কি খবর? ছেলের অবস্থা কি? চাচা এমনভাবে আমার দিকে তাকালেন, বুকটা কেন জানি কেঁপে উঠল। চাচা বললেন, আমার সব শেষ। কি হয়ছে চাচা?
ষ্ট্যাডি-৫ : চাচা বললেন, ছেলে ইয়াবায় আসক্ত!! আমি যেন হঠাৎ ভুল শুনছি। আমার সমস্ত ভাবনা, আবেগ সব যেন শেষ হয়ে গেছে। আহ! চাচাকে বহু সান্তনা দেয়া যেত, বহুকথা বলা যেত, কিছুই বলিনি। কতটুকু গিয়েই নেমে পড়লাম। বহুক্ষণ হাঁটলাম। চাচার অবস্থা কল্পনা করলাম। বাবার অবস্থান থেকে বিষয়টি ভাবলাম।
এক শিশু পড়ছে তার বাল্যশিক্ষা বইয়ে: সদা সত্য কথা বলিবে। মিথ্যে কথা বলিবে না। মিথ্যে বলা মহাপাপ। মিথ্যেবাদী কষ্ট পায়। মেয়েটি পড়ছে। আর মা-কে জিজ্ঞেস করছে, মা সত্য কী? মিথ্যে কী? পাপ কী? মা এক এক করে বলছেন। একপর্যায়ে সে আঁতকে উঠে বলল-মা তাহলে আব্বুর কী হবে? আব্বু তো কষ্ট পাবে? মা বললেন, কেন? মা সেদিন বাসায় আমি আর বাবা ছিলাম।
একজন এসেছিলেন। আমি দরজা খুলতে গেলে-বাবা বললেন, খুলিশ না! খুলিশ না! কয়েকবার বেল দিয়ে এমনিই চলে যাবে। ভাববে বাসায় কেউ নেই। অথচ বাসায় তো আমরা ছিলাম! আসলে সেদিন যিনি এসেছিলেন, তিনি দুধওয়ালা। সেদিন তার পাওনা টাকা নেয়ার কথা ছিল। এই সময়কার শিশুদের নৈতিক শিক্ষা দিতে হলে আগে যে আমাদের বড়দের নৈতিকতা ঠিক আছে কিনা তা দেখতে হবে। সেজন্যে সন্তানকে নৈতিকতা শেখা। দরকার মূল্যবোধ শেখানো। দরকার ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলার কথা বলা।
এখন শেখানোর বিষয় হচ্ছে নৈতিকতা। এর সিলেবাস কতটুকু? বিশাল সিলেবাস, এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তবে এই সিলেবাসের প্রথম পর্ব হচ্ছে সত্য বলার চর্চা। খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। বলা যেতে পারে যে, সকল অন্যায়ের শুরু এই মিথ্যা দিয়ে। সত্য থেকে বিচ্যুতির কারণে। এক লোক যখন নবীজী (স)-এর কাছে এসে বললেন, আমি অনেক কিছু মানতে পারব না। আমাকে একটি নির্দেশনা দিন। তবে যেটি দেবেন সেটিই আমি অক্ষরে অক্ষরে পালন করব। নবীজী (স) তাকে বলেছিলেন মিথ্যা বলো না।
নবী (স.) শিক্ষা কতটা জরুরী সেটি ১৫শত বছর পরও আমরা উপলব্দি করি। শাসন বা মারধরে না গিয়েও এই স্বভাব রুখে দেয়া সম্ভব। মনোবিদদের মতে, শিশুকে প্রথম থেকেই গল্পের ছলে মনীষীদের জীবনী, ঈশপের নানা গল্প, নীতিকথা শেখান। বড় মানুষরা কেউ মিথ্যা পছন্দ করছে না অথবা মিথ্যা বিষয়টা খুব একটা গ্রহণীয় নয়-সে ধারণা মনের মধ্যে প্রবেশ করান। শিশুদের সামনে যতটা সম্ভব মিথ্যা এড়িয়ে চলুন। তারা কিন্তু অভিভাবকদের থেকেই সবচেয়ে বেশি শেখে। তাই পারিবারিক নানা কারণে অতিকথন, মিথ্যা এড়িয়ে চলুন।
 মিথ্যা বলা কতটা খারাপ কিংবা আপনাদের বাড়ির সব সদস্য এই মিথ্যা বলাকে কতটা ঘৃণা করেন-সে সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা দিন। অতি আদর করতে গিয়ে তার হাতে দামি ফোন, নগদ টাকা, যা আবদার করে তা দেয়া থেকে বিরত থাকুন। অন্যথায় দেখবেন একদিন আপনার সবই থাকবে কিন্তু কিছুই থাকবে না। হারাতে হবে সবই।
আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থা সেকালের। এখানে এক ধরনের কেরানী বানানোর মেশিন। একটি সুযোগে সেই মেশিন আরো জমজমাটভাবে করছে তথাকথিত শিক্ষা প্রসাশন। ২০২২ সালে শিক্ষা কোন দিকে যাবে তার কোন কথাই নাই। গতকাল দেখলাম ২০২৩ ও ২০২৪ সালে কি হবে তা নিয়ে শ্ষিামন্ত্রী ব্যস্ত সময় পার করছেন।সন্তানকে সু-শিক্ষা ও নৈতিক শিক্ষা দিন। তার পাশে থাকুন-নিজ দায়িত্বে আপনার সন্তানের কজ আপনিই তদারকি করুন।  সন্তান আলোকিত হউক-বেড়ে উঠুক বাবা-মায়ের স্বপ্ন পূরণে-

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *