ডক্টর মুহাম্মদ কামাল উদ্দিন

শিক্ষাবিদ-নজরুল গবেষক

২০ ফেব্রুয়ারি।। ২০২২।। রোববার।।

জয় বাংলা !! জয় বাংলা : পূর্ণ-অভিনন্দন-
‘জয় বাংলা’-কে জাতীয় শ্লোগান করার আদেশ রয়েছে আদালতের একটি রায়ে। তারই আলোকে গতকাল মন্ত্রী পরিষদের বৈঠকে এই বিষয়ে দিক-নির্দেশনা ও প্রজ্ঞাপনের সিদ্ধান্ত আমরা অনেকেই জেনেছি। জাতীয় কবি কাজি নজরুল ইসলামের ‘পূর্ণ-অভিনন্দন’ কবিতাটি ভাঙারগান কাব্যগ্রন্থে রয়েছে। ভাঙারগান মূলত একটি গান। ভাঙারগান ১৯২৪ সালে প্রকাশিত হয়। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে নজরুলের যে অবস্থান  ভাঙারগানে মূলত. সেই দিকটিই বেশি উচ্চারিত হয়েছে। পাঠকের বুঝরে সুবিধার্থে এর কয়েকটি লাইন তুলে ধরছি-
ওগো অতীতের আজো-ধূমায়িত আগ্নেয়গিরি ধূম্রশিখ!
না-আসা-দিনের অতিথি তরুণ তব পানে চেয়ে নিনিমিখ।
জয় বাংলার পূর্ণচন্দ্র, জয় জয় আদি-অন্তরীণ!
জয় যুগে-যুগে-আসা-সেনাপতি, জয় প্রাণ আদি-অন্তহীন!
স্বাগত ফরিদপুরের ফরিদ, মাদারিপুরের মর্দবীর,
বাংলা-মায়ের বুকের মানিক, মিলন পদ্মা-ভাগীরথীর!
আর এই বোধ-বিবর্তনের পথে বাঙালি কবির কণ্ঠে বিজয়সূচক ব্রহ্মধ্বনি ‘জয় বাংলা’। এটি উচ্চারিত হয়েছে বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকের শুরুতে, যখন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম তার ‘পূর্ণ-অভিনন্দন’ কবিতাটি লিখলেন। কবিতাটি ১৯২৪ সালে প্রকাশিত তাঁর ভাঙার গান শীর্ষক গ্রন্থে সঙ্কলিত হয়েছে। বলা বাহুল্য, ১৩৩১ বঙ্গাব্দের শ্রাবণ ১৯২৪ সালের আগস্ট মাসে প্রকাশিত হওয়ার মাস তিনেকের মধ্যে অর্থাৎ ১১ নভেম্বর তারিখে বইটি বৃটিশ সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। তার পর থেকে এই বইয়ের উপর এই নিষেধাজ্ঞাটি আর প্রত্যাহার করা হয়নি। এই গ্রন্থের প্রথম কবিতার প্রথম পঙক্তি, ‘কারার ঐ লৌহ-কবাট / ভেঙে ফেল কররে লোপাট / রক্ত-জমাট / শিকল-পুজোর পাষাণ-বেদী!/’।
‘নজরুলেরর সেই ‘জয় বাংলা’ কণ্ঠে নিল বাংলার গণপ্রকৃতি, বিলঝিল, শঙ্খচিল, ধরিত্রী উদগ্রীব …/ নজরুলেরর সেই ‘জয় বাংলা’ কণ্ঠে নিল বাঙালির অভিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। মাত্র এগারোটি কবিতা নিয়ে সঙ্কলিত এই ব্রিটিশ বিরোধী কাব্যগ্রন্থের চতুর্থ কবিতা ‘পূর্ণ-অভিনন্দন’। অগ্নিযুগের অগ্নিপুরুষ মাদারিপুরের শান্তি সেনাবাহিনীর প্রধান অধ্যক্ষ শ্রীযুক্ত পূর্ণচন্দ্র দাস মহাশয়ের কারা-মুক্তি উপলক্ষে নজরুল এই কবিতাটি রচনা করেন। কবিতাটি তিনি সঙ্গে সঙ্গে আবৃত্তি করেন এবং হারমোনিয়াম সহকারে গেয়ে শোনান। ছয়-পঙক্তির নয়টি স্তবকে সজ্জিত মোট পঙক্তি ৫৪-এই দীর্ঘ কবিতাটি নজরুল তাঁর স্বভাবসুলভ মাত্রাবৃত্তের ধ্বনি-ঝঙ্কারে সংগ্রথিত করেছেন। প্রতিটি পঙক্তিতে ছয় মাত্রার তিনটি পর্ব ও তারপর একটি অপূর্ণ পর্ব। এই বিন্যাস একটি সুসজ্জিত সৈন্যদলের শৃঙ্খলাপরায়ণ মার্চপাস্টের ভঙ্গি ও বীর্যবত্তাকে স্মরণ করিয়ে দেয়। এই কবিতার সুশৃঙ্খল চরণে-স্তবকে বাংলার ইতিহাস, পুরাণ, কিংবদন্তির পাশাপাশি বাঙালির ভবিষ্যৎ মুক্তিযুদ্ধ ও অবশ্যম্ভাবী বিজয়ের বার্তা আভাসিত হয়ে আছে।
১৯৪২ সালে বঙ্গবন্ধু কলকাতায় ছিলেন, নবযুগ পত্রিকার সেই উদ্দীপ্ত প্রবন্ধ তাকে তখন বা পরে উজ্জীবিত করে থাকতে পারে। ২০১১ ও ২০১৫ সালে বঙ্গবন্ধু কন্যা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানান যে, কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা থেকেই বঙ্গবন্ধু এই “জয় বাংলা” স্লোগানটি নিয়েছিলেন। ১৯৭১ বাঙালি জাতির অমলিন যুগচিহ্ন। স্বাধীনতা তার সোনালি ফসল। হাজারো কণ্ঠে উচ্চারিত ‘জয় বাংলা’ শব্দটি ধাবমান শক্তিতে রূপান্তরিত হয়েছিল, যার ফলশ্রুতিতেই স্বাধীন স্বদেশ পেয়েছিল এই বঙ্গ। ‘জয় বাংলা’ শব্দটি প্রথম কে বলেছিলেন? কী তাঁর পরিচয়?
আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। বিদ্রোহী কবি, প্রেমের কবি, গানের কবি, মানবতার কবি, বাঙালির স্বাধিকারের কবি নজরুল ইসলামই প্রথম ‘জয় বাংলা’ শব্দটি লিখেছিলেন। আর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেই ‘জয় বাংলা’ শব্দটিকে শানিত অস্ত্রের মত ব্যবহার করেছিলেন। আপামর জনতা বিস্ফোরিত হয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ। শহীদ হয়েছিল আমার ভাইয়েরা, বোনেরা হারিয়েছিল সম্ভ্রম। হাজারো ত্যাগ-তিতীক্ষার বিনিময়ে এই বাংলার বুকে উড়ছে জয় বাংলার লাল-সবুজ পতাকা।
১৯৪২ সালে ‘বাঙালির বাঙলা’ প্রবন্ধে কাজি নজরুল লিখেছেন—‘বাঙালিকে, বাঙালির ছেলেমেয়েকে ছেলেবেলা থেকে শুধু এই এক মন্ত্র শেখাও-‘এই পবিত্র বাংলাদেশ/বাঙালির-আমাদের।/দিয়া ‘প্রহারণে ধনঞ্জয়’/তাড়াব আমরা, করি না ভয়/যত পরদেশী, দস্যু ডাকাত/রামা-দের গামা-দের’। বাংলা বাঙালির হোক, বাংলার জয় হোক, বাঙালির জয় হোক।
আবারও বলি, জয় বাংলার পূর্ণচন্দ্র, জয় জয় আদি-অন্তরীণ! আমরা শিক্ষাদীক্ষায়, গণতন্ত্রে, শাসন ব্যবস্থায় পরিশুদ্ধ হওয়ার মধ্য দিয়ে কাজি নজরুলের যেই জয়বাংলা ছিল তাকে জীবিত রাখতে হবে। বঙ্গবন্ধুর মুক্তির ডাককে জনগণের অধিকারে দাঁড় করানোর মধ্য দিয়েই কেমন সেই স্বপ্ন গুলো বাস্তবে রূপ নিতে পারে। অন্যথায় এই গুলো শুধু ধারণ করা হবে লালনের জায়গাটি শূণ্য পড়ে থাকবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *