কখনো তাঁরা দরিদ্র, মেধাবী শিক্ষার্থীদের পড়ার খরচ জোগান। কখনো ভাঙা রাস্তা মেরামত করে দেন, বানিয়ে দেন সাঁকো। করোনাকালে বাড়ি বাড়ি গিয়ে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার খোঁজ নেন, অভিভাবকদের বোঝান। করোনায় কাজ হারানো দরিদ্র মানুষের পাশেও দাঁড়ান তাঁরা। অনেককে খাদ্যসহায়তা দেন।
কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের এমন উদ্যোগে অনেকখানি পাল্টে গেছে যশোরের কেশবপুর উপজেলার বড়েঙ্গা গ্রামের চিত্র। আদর্শ গ্রাম গড়তে বছর তিনেক আগে একদল তরুণ মিলে স্টুডেন্ট ওয়েল ফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলেন।

সম্প্রতি ওই গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, কয়েকজন তরুণ ইটবিছানো সড়ক সংস্কারের কাজে ব্যস্ত। কথা হয় নূর আলম খান, রাকিব হোসেন, রাজ কুমার, অরুপ বিশ্বাস, শোয়াইব খান, মুরাদ খান, রেজোয়ান শেখ ও বাবুল আক্তারের সঙ্গে। তাঁরা সবাই কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। সংগঠনের সভাপতি বাবুল আক্তার বড়েঙ্গা গ্রামের মানুষ। পাশের গ্রাম হিজলডাঙ্গার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফলিত গণিত বিষয়ে পড়াশোনা তাঁর।
এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, শিশুদের লেখাপড়ার বিষয়টি তাঁদের কাছে অগ্রাধিকার। অভাবের তাড়নায় অনেক শিশুকে স্কুল ছেড়ে কাজে যোগ দিতে হয়। এ ধরনের খবর পেলেই অ্যাসোসিয়েশন ওই শিশুদের অভিভাবকদের কাছে ছুটে যায়। তাঁদের শিক্ষার গুরুত্ব বোঝায়। প্রয়োজনে আর্থিক সহায়তা দেয়। এভাবে ওই শিক্ষার্থীকে আবার বিদ্যালয়মুখী করে তোলা হয়। এমনই এক শিক্ষার্থী মিনারুল ইসলাম। অভাবের কারণে কাজে ঢুকে পড়ায় কামরুল ইসলামের ছেলে মিনারুলের পড়ালেখা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তাকে আবার বড়েঙ্গা এনএসএইচ দাখিল মাদ্রাসায় সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি করে দেন তাঁরা। একইভাবে লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যাওয়া দুই ছাত্রী ফারজানা ইয়াসমিন ও শারমিন সুলতানাকে আর্থিক সহায়তা দিয়ে পঁচারই মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়াচ্ছেন তাঁরা।

ভ্যানচালক ফারুক হোসেন বলেন, তাঁর তৃতীয় ও অষ্টম শ্রেণিতে পড়ুয়া সন্তানদের পড়াশোনার নিয়মিত খোঁজখবর নেন সংগঠনের ছেলেরা।
সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক নূর আলম শেখ। তিনি যশোর এম এম কলেজে স্নাতক (সম্মান) শেষ বর্ষে পড়ছেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের মানবসেবার কাজের সাথে থাকতে হবে। যার মধ্যে সমাজ উপকৃত হয়।’
শিশুদের পড়াশোনার তদারকির পাশাপাশি গ্রামের মানুষের সমস্যা সমাধানেও সাধ্যমতো অবদান রাখার চেষ্টা করে সংগঠনটি। গত বছর বড়েঙ্গা গ্রামের সঙ্গে আলতাপোল গ্রামের সংযোগ স্থাপন করতে হরিহর নদের ওপর তৈরি করা হয় বাঁশের সাঁকো। গ্রামের বয়োজ্যেষ্ঠদের সঙ্গে নিয়ে স্টুডেন্ট ওয়েল ফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যরা বসে সিদ্ধান্ত নেন সবার সহায়তায় তৈরি করা হবে সাঁকোটি। গ্রামের লোকদের কাছ থেকে বাঁশ নিয়ে বানানো হয় সাঁকোটি। বড়েঙ্গা থেকে কেশবপুর আসতে নয় কিলোমিটার পথ। সাঁকোটি হওয়ায় দূরত্ব কমে ছয় কিলোমিটারে দাঁড়ায়।
করোনা পরিস্থিতির কারণে স্কুল বন্ধ থাকায় গ্রামের শিশুরা লেখাপড়া থেকে বিচ্ছিন্ন। তাদের লেখাপড়ায় মনোযোগী করে তুলতে সন্ধ্যার পর বাড়ি বাড়ি গিয়ে লেখাপড়ার খোঁজ নেন সংগঠনের সদস্যরা।
করোনায় গ্রামের যাঁরা কাজ হারিয়ে অর্থনৈতিক কষ্টে আছেন, তাঁদের সংগঠনের পক্ষ থেকে খাদ্য সরবরাহ করা হয়। ৫০ জন সদস্য প্রতি মাসে ৫০ থেকে ১০০ টাকা চাঁদা দেন। গ্রামের বাসিন্দা যাঁরা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে কর্মরত, তাঁদের কাছ থেকেও আর্থিক সহায়তা নেয় সংগঠনটি। করোনাকালে গ্রামের মোড়ে মোড়ে সাবানপানির ব্যবস্থা করা হয়েছে। স্যানিটাইজার, মাস্ক বিতরণ করা হয়।
ইউএনও এম এম আরাফাত হোসেন বলেন, ‘গ্রামের যুবকদের এ ধরনের ভালো কাজ প্রশংসার দাবিদার। প্রশাসনের পক্ষ থেকে যদি কোনো সহায়তা করা লাগে, অবশ্যই তা করব।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *