‘আরে মে তু ঝে কাহানা, বিকেলে খেলব না, আই অ্যাম বিজি।’
‘প্লিজ গো, নেহি তো গজব হো যায়ে গ্যয়া, আজকে ফুটবলের ফাইনাল খেলা না?’
এমনই কথোপকথন চলছিল তাইমি আর অর্পার মধ্যে। দুজনের একজন পড়ে ইংলিশ ভার্সনে। আরেকজন বাংলা মিডিয়ামে। যাদের বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে, তাদের জন্য দুজনের এই কথোপকথন সহজ করে দিই। প্রথমজন বলেছে, ‘তোমাকে বললাম না আমি ব্যস্ত, বিকেলে খেলব না।’ আর দ্বিতীয়জন উত্তরে বলেছে, ‘আজ তো ফুটবলের ফাইনাল খেলা। চল, না হলে সর্বনাশ হবে।’
অর্পা আর তাইমি হিন্দি, বাংলা আর ইংরেজির মিশেলে এভাবেই কথা বলে। রাজধানীর ধানমন্ডি এলাকায় পাশাপাশি বাড়িতে থাকে ওরা। অর্পাদের বাসার নিচের ফাঁকা জায়গায় রোজ সকাল-বিকেল খেলাধুলা করে ওরা। খেলার দলটাও বেশ বড় ওদের। ওদের বন্ধু লিসা পড়ে এলাকার সরকারি স্কুলে, সানিয়া মিশনারি স্কুলে আর রাহাত, রায়না, জারেফ পড়ে ঢাকার নামকরা দুটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে। সবারই বয়স নয় থেকে বারোর মধ্যে। ওরা যখন গল্পে মেতে থাকে, একটু খেয়াল করলে দেখা যায়, সবাই নানা ভাষার মিশেলে কথা বলছে।
তিন ভাষার মিশেলে ওদের এমন কথাবার্তার আরেকটু উদাহরণ দেওয়া যাক। জারেফের পোষা পাখির নাম সিন্ডি। পোষা পাখি নিয়ে ওর গল্প হচ্ছিল বন্ধু সানিয়ার সঙ্গে। জারেফ বলে, ‘সিন্ডি ইজ ডিপ্রেসড টুডে, উসকি পসন্দ কি খাবার নেহি মিলি না, বাবাকে কিন্তু বলেছিলাম গাজর আনতে।’ অর্থাৎ ‘পছন্দের খাবার না পাওয়ায় আজ সিন্ডির মন ভালো নেই। বাবাকে কিন্তু বলেছিলাম গাজর আনতে।’ উত্তরে সানিয়া বলে, ‘সো স্যাড।’ অর্থাৎ ‘খুব দুঃখজনক।’
ছেলেমেয়েদের এ রকম মিশ্র ভাষার কথা বলা নিয়ে কী ভাবছেন তাদের অভিভাবকেরা? তাইমির মা শাহনাজ পারভীন বলেন, ছোটবেলা থেকে ইংরেজি-হিন্দি কার্টুন বেশি দেখে তাইমি। ইউটিউবের বিভিন্ন ভিডিও তো দেখেই। বাসায় তাঁরা বাংলাতেই কথা বলেন। হয়তো তিনটা ভাষাই সে রপ্ত করেছে। আরেকটু বড় হলে ঠিক হয়ে যাবে বলে মনে করেন এই অভিভাবক। শাহনাজ বলেন, তিনি চান বাঙালি হিসেবে সন্তান শুদ্ধ বাংলাতেই কথা বলুক। কিন্তু যুগের বদলের সঙ্গে এই পরিবর্তন মেনে তো নিতেই হবে।
ইংরেজি, বাংলা না হিন্দি, কোনটাতে কথা বলতে বেশি ভালো লাগে—এমন প্রশ্ন শুনে অবশ্য কিছুটা ভাবনায় পড়ে যায় তাইমি। এবার সচেতন হয়ে শুধু বাংলাতেই বলে, ‘আমি তো এভাবেই কথা বলি। এভাবেই ভালো লাগে।’
তবে শিশুদের বিভিন্ন ভাষায় কথা বলার ধরন সবাই স্বাভাবিকভাবে নিতে পারে না। এ কারণে বুলিং বা সামাজিকভাবে হেয় করা হচ্ছে কোনো কোনো শিশুকে। কিছুদিন আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ওরিন নাশিদ একটি স্ট্যাটাস দেন। তিনি জানান, তাঁর চার বছরের মেয়ে সরৌশী অনর্গল ইংরেজিতে কথা বলে। সে বাংলা শোনে ও বুঝতে পারে। বাড়িতেও তাঁরা সব সময় বাংলায় কথা বলেন। কিন্তু মেয়েটি কথা বলার জন্য ইংরেজি বেছে নিয়েছে। ইংরেজিতে কথা বলার জন্য শিশুটির সঙ্গে কেউ খেলে না। মেশে না। শিশুটি নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ছে। অন্য অভিভাবকেরাও তাঁদের শিশুদের বিষয়টি বোঝান না। বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক এলাকায় থাকেন তিনি। সেখানে এমন পরিস্থিতির শিকার হওয়ায় হতাশা প্রকাশ করেন এই শিক্ষক।
শুধু হিন্দি, বাংলা বা ইংরেজির মিশেলই নয়, মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা নিশাত কথা বলায় সময় কোরিয়ান ভাষা ব্যবহার করে। সে কোরিয়ার বিভিন্ন ব্যান্ডদলের গানের ভক্ত। অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী নিশাত ইংরেজি ভার্সনের একটি স্কুলে পড়ে। সকালে ঘুম ভাঙার পরেই বাবাকে নিশাত বলে, ‘বাবা, আনিওংহাসেও।’ অর্থাৎ হ্যালো বাবা। স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার সময় নিশাত ও তার বন্ধুরা একে অন্যকে বলে আনিওং। কাল আবার দেখা হবে। অর্থাৎ বিদায়। কাল আবার দেখা হবে।
বাসায় খেলছে দুই শিশু। তারা বাংলা,ইংরেজি, হিন্দির সঙ্গে কোরিয়ান ভাষাতেও কথা বলেছবি: প্রথম আলো
নিশাতের বাবা তারেক আহমেদ বলেন, মেয়ের মুখে কোরিয়ান গান শুনতে ভালোই লাগে। মেয়ের কাছ থেকে তিনিও শিখছেন কোরিয়ান ভাষা। বাবা-মেয়ে কথা বলার সময় মাঝেমধ্যেই কোরিয়ান ভাষা চর্চা করেন।
মেয়ে নিশাতের বিভিন্ন ভাষায় কথা বলা বাবা যেভাবে উপভোগ করেন, তেমনটা অবশ্য সবার ক্ষেত্রে ঘটে না। যেমন রাজশাহীতে তিন বছরের শিশুকে (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) নিয়ে বিপদে পড়েছিলেন তার মা-বাবা। শিশুটি দুর্বোধ্য ভাষায় কথা বলত। সেটা না ইংরেজি না বাংলা। তাঁর কোনো কথার অর্থ বোঝা যেত না। আর অর্থ বুঝতে না পারলে সে ভীষণভাবে রাগারাগি করত। কান্নাকাটি করত। নিরুপায় মা-বাবা শিশুটিকে নিয়ে যান মনোবিদ তানজির আহমেদের কাছে। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট।
মনোবিদ তানজির আহমেদে জানান, শিশুটির মা-বাবা দুজনেই ভীষণ ব্যস্ত। শিশুটি বেশির ভাগ সময় টিভিতে সময় কাটাত। বাংলা, হিন্দি, ইংরেজি—বিভিন্ন ভাষা শুনতে শুনতে সে আসলে কোন ভাষায় কথা বলবে, তা বুঝতে পারেনি। কিন্তু তার কথা বলার প্রবল আগ্রহ। তাই সবকিছুর মিশেলে নিজের মতো করে সে দুর্বোধ্য ভাষা তৈরি করেছে। যেটা হয়ে গেছে খিচুড়ি ভাষা। কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে ও যেকোনো একটি ভাষায় প্রচুর কথা বলার মাধ্যমে শিশুটি পরে স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে পেরেছে।
১০ বছরের রুফাইদা একটি মিশনারি স্কুলের ছাত্রী। বাসায় দুই ভাই–বোন প্রায়ই হিন্দিতে কথা বলে। বাংলা, ইংরেজিও চলে। এ নিয়ে খুব বেশি মাথা ঘামাননি রুফাইদার মা-বাবা। তবে রুফাইদার বাসায় সেদিন তাঁর মায়ের এক শিক্ষক বেড়াতে আসেন। তিনি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সংস্কৃত ভাষার শিক্ষক। মায়ের শিক্ষক রুফাইদাকে প্রশ্ন করেন, ‘তুমি কেমন আছ?’ উত্তরে রুফাইদা বলে, ‘ভালো আছি। আপ কেসি হ্যায়?’ অর্থাৎ আপনি কেমন আছেন?
রুফাইদার মা বলেন, সেদিন তাঁর শিক্ষক জানতে চেয়েছিলেন এমন জগাখিচুড়ি ভাষা রুফাইদা কোথায় শিখেছে? খুবই বিব্রত হয়েছিলেন তিনি।
এ ধরনের পরিস্থিতি এড়াতে পরামর্শ দিয়েছেন মনোবিদ তানজির আহমেদ। তিনি বলেন, শিশু বা টিনএজাররা সচেতনভাবে দুই থেকে তিন রকম ভাষার মিশেলে কথা বলে না। এভাবে কথা বলা নিয়ে অভিভাবকদের খুব বেশি উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ নেই। বাধা দেওয়া বা উৎসাহিত করারও প্রয়োজন নেই। যেটা জরুরি, সেটা হলো কোন পরিস্থিতিতে কোন ভাষায় কথা বলা দরকার, সেটা শেখানো। শিশুদের শেখাতে হবে বন্ধুমহলে তারা নিজেদের মতো করে যেকোনো ভাষায় কথা বলতেই পারে। তবে সে যখন ক্লাসে শিক্ষকের সঙ্গে, কোনো অনুষ্ঠানে বা কোথাও বেড়াতে যাবে, তখন তাকে যেকোনো এক ভাষাতেই শুদ্ধভাবে কথা বলতে হবে। শিশু মাতৃভাষা শিখলে অন্য সব ভাষাই রপ্ত করতে পারবে। স্থান, কাল, পাত্র বুঝে ভাষার ব্যবহার শিশুকে শেখানোটা জরুরি। আর সেই শিক্ষা পরিবার থেকেই শুরু করা যায়।
ধানমন্ডির বাসিন্দা নাতনি সানিয়ার মিশ্র ভাষার কথা শুনে উদ্বেগ প্রকাশ করলেন সানিয়ার নানি। যশোর থেকে ঢাকায় বেড়াতে এসেছেন তিনি। সরকারি একটি কলেজে বাংলার অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক। তাঁর মতে, যত বেশি ভাষা জানা যায় তত ভালো। কিন্তু কথা বলার সময় মাতৃভাষাতেই বেশি জোর দেওয়া উচিত। আজকালের বাচ্চারা এত বেশি ইংরেজি আর হিন্দি কার্টুন দেখে, ইউটিউবে ভিডিও দেখে যে তা সম্ভব হয় না।
শিশু-কিশোরদের বিভিন্ন ভাষার মিশেল নিয়ে কথা বলতে গিয়ে শিক্ষাবিদ রাশেদা কে চৌধূরী উদাহরণ দিলেন ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর। যখন বাংলায় বক্তব্য দেন, তখন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী অনর্গল বাংলা বলেন। তাতে একটিও ইংরেজি শব্দ থাকে না। আবার যখন ইংরেজিতে বক্তব্য দেন, তখন অনর্গল ইংরেজি বলেন। তাতে একটিও বাংলা শব্দ থাকে না। বিষয়টা এমনই হওয়া উচিত।
রাশেদা কে চৌধূরীর মতে, ভাষাশিক্ষা ও যোগাযোগদক্ষতা—দুটির মধ্যে পার্থক্যটা আমাদের মনে রাখা দরকার। শ্রেণিকক্ষে অনেক শিক্ষক বাংলা, ইংরেজি ও আঞ্চলিকতার মিশেলে কথা বলেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক বা মুঠোফোনের খুদে বার্তা, পোস্টার, বিলবোর্ডেও ভাষার মিশেল থাকে। এসবেরই প্রভাব পড়ে শিশু-কিশোরদের ওপর। এ ক্ষেত্রে শিশুদের শুদ্ধ ভাষাচর্চার ওপর পরিবারকে জোর দিতে হবে। তাদের উৎসাহিত করতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও এই চর্চার প্রয়োজন। সবকিছু শুধু পরীক্ষা ও পুস্তককেন্দ্রিক যেন না হয়। শিশুরা বিভিন্ন ভাষা শিখবে, কিন্তু যেকোনো ভাষার বিশেষ করে মাতৃভাষার শুদ্ধ চর্চাটা জরুরি বলে মনে করেন এই শিক্ষাবিদ।