‘ভিকটিম ও সাক্ষীকে সুরক্ষা দেওয়ার মতো কোনও আইন বাংলাদেশে নেই বলে কোনও মামলা দায়ের করার পর নির্যাতনের শিকার ব্যক্তি বা ভিকটিম সাধারণত অসহায় হয়ে পড়েন। ভিকটিমরা বিভিন্ন সেবাদানকারী সংস্থার কাছ থেকে হুমকির সম্মুখীন হচ্ছেন। এছাড়া স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধিদের ভূমিকা ভিসহায়তা তো করেই না, বরং ভিকটিমদের হুমকি দিয়ে থাকেন।’ বেসরকারি সংস্থা মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের গবেষণার অংশ হিসেবে মাঠপর্যায়ের বিভিন্ন কেস স্টাডিতে এ তথ্যগুলো উঠে এসেছে।বুধবার (২১ অক্টোবর) মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন আয়োজিত এক ওয়েবিনারে এ তথ্য তুলে ধরেন সংস্থার লিড কনসালটেন্ট ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার তাপস কান্তি বাউল। বাংলাদেশে নির্যাতনের শিকার ব্যক্তি বা ভিকটিম এবং সাক্ষী বা উইটনেসের সুরক্ষা পরিস্থিতি বিশ্লেষণ এবং এর ওপর ভিত্তি করে একটি ভিকটিম অ্যান্ড উইটনেস প্রটেকশন অ্যাক্ট প্রণয়নে সহায়তা করার জন্য মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন এই গবেষণা করেছে। ‘ভিক্টিম অব ক্রাইম অ্যান্ড উইননেস প্রটেকশন’ বিষয়ক খসড়া প্রতিবেদনের ওপর গবেষণা করে চূড়ান্ত প্রতিবেদনটি আলোচনার জন্য উপস্থাপন করা হয়।
গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্য তুলে ধরে তাপস কান্তি বলেন, ‘ভিকটিমরা তাদের আইনগত অধিকার সম্পর্কে জানেন না। এমনকি যারা বলেন যে, ভিকটিম প্রটেকশন আইন আছে, তারাও অনেক সময় ঠিক মতো বলতে পারেন না, আইনটা কী এবং কী ধরনের প্রটেকশন দেওয়া হবে বা হচ্ছে? গবেষণায় ৫১ ভাগ উত্তরদাতা বলেছেন তারা জানেন যে, ভিকটিমকে সুরক্ষা দেওয়ার এরকম কোনও আইন নেই। যারা বলেছেন যে, ভিকটিমকে সুরক্ষা দেওয়ার মতো কোনও আইন নেই, তাদের শতকরা ৭৯ ভাগ মনে করেন— এই রকম আইন থাকা উচিত।’
গবেষণা প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, ভিকটিমদের জন্য অর্থনৈতিক সহায়তা সবচেয়ে বেশি দরকার। কারণ, অধিকাংশ ভিকটিম দরিদ্র এবং দিনমজুর। কাজেই তাদের পক্ষে আদালতে উপস্থিত থাকার মতো যাতায়াত খরচ ও খাবার কিনে খাওয়ার টাকা থাকে না। ভিকটিমরা সামাজিক নিরাপত্তা চান, যাতে তারা স্থানীয় আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের মারফত হয়রানির শিকার না হন।
গবেষণার সুপারিশমালায় বলা হয়েছে, দ্রত ভিকটিম ও উইটনেসের জন্য আইনটি বাস্তবায়ন করা, প্রতি জেলায় ভিকটিম ও উইটনেসের জন্য অফিস প্রতিষ্ঠা করা, পুলিশ স্টেশনে ভিকটিম এবং উইটনেসের জন্য প্রটেকশন সেল গঠন করা, আর্থিক ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করা, ভিকটিমদের প্রতি সম্মান দেখানো এবং তাদেরকে আইন সম্পর্কে জানানোটা খুব জরুরি।
ওয়েবিনারে বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট সালমা আলী বলেন, ‘আমাদের যত আইন আছে সব ব্রিটিশ শাসনামলের। মানবপাচারের ক্ষেত্রে ভিক্টিম অ্যান্ড উইটনেস প্রোটেকশনের বিষয়টি আমরা দিয়েছিলাম, কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় যে, আসামিরা ভিক্টিমকে ভয় দেখালে বা কিছু করলে, তখন সে শুধু একটা জিডি করতে পারে। ওই জিডি পর্যন্তই, পুলিশ কিন্তু কোনোদিন তদন্ত করে দেখেনি। আইন শুধু থাকলে হবে না, আইন প্রয়োগের সাপোর্ট সার্ভিসগুলার বিষয়গুলোও দেখতে হবে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড মিজানুর রহমান বলেন, ‘আমাদের কিন্তু আইনের টেকনিক্যাল বিষয়গুলো নিয়ে গায়ে লাগানো উচিত না। বরং আমাদের জোর থাকতে হবে একজন সাধারণ মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি এবং বুঝের বিষয়টি দেখতে হবে। এই সহজ সত্যটি যদি আমরা আয়ত্ত করতে পারি, তাহলে কিন্তু আমার হাতরিয়ে বেড়ানোর প্রয়োজন পড়বে না। মানুষ জানে সাক্ষী কে, ভিক্টিম কে। মানুষ জানে তার কী দরকার। সেটি হয়তো আইনের ভাষায় আমরা পরিষ্কার করে উপস্থাপন করতে চাই। কিন্তু এখানে যদি আমরা আইনের টেকনিক্যাল জিনিসের মধ্যেই আবদ্ধ হয়ে যাই, এতে করে যে উদ্দেশ্যে আইনটি তৈরির কথা, সেটি কিন্তু হারিয়ে যায়।’
মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম বলেন, ‘খসড়াটির ওপর সবাই যে সুচিন্তিত মতামত দিয়েছেন, সেটি আরও সমৃদ্ধ হবে আশা করি। এটি একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া, এটি আমাদের শুরু। খসড়াটি নিয়ে আমরা আরও অভিজ্ঞ গ্রুপের সঙ্গে বসবো। শুধু অভিজ্ঞরাই নন মাঠ পর্যায়ে যারা কাজ করছেন, তাদের মতামতও বিবেচনা করার মতো।’