যুক্তরাষ্ট্রে ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর সন্ত্রাসী হামলার পরপরই সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে বৈশ্বিক যুদ্ধ শুরু করে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের প্রশাসন। প্রথমেই মার্কিন বাহিনী অভিযানে নামে আফগানিস্তানে। এর দুই বছর পর শুরু হয় ইরাকে অভিযান। আফগানিস্তানে তালেবান ও ইরাকে সাদ্দাম হোসেনের সরকারের পতন ঘটে। কখনো প্রকৃত স্বাধীনতার স্বাদ না পাওয়া আফগান ও ইরাকিরা কিছু সময়ের জন্য মুক্তির আনন্দ পায়। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধ আর সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড আরও ব্যাপক রূপ নেয়। তার প্রভাব পড়ে পুরো বিশ্বে।

আফগানিস্তানে তালেবানকে হটিয়ে নিজেদের ‘পুতুল’ সরকার প্রতিষ্ঠা করে যুক্তরাষ্ট্র। সেখানে ঘাঁটি গাড়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর সেনারা। তালেবানের প্রতিষ্ঠাতারা এ সময় পাড়ি জমায় পাকিস্তানে। মার্কিন চাপে পড়ে সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইয়ে যুক্ত হয় পাকিস্তানও। তবে তাদের বিরুদ্ধে রয়েছে তালেবানকে সহযোগিতা করার অভিযোগ। ফলে তালেবানকে প্রকৃত অর্থে কখনোই হারাতে পারেনি যুক্তরাষ্ট্র। আফগানিস্তানে মার্কিন সামরিক অভিযান এবং ক্ষমতা থেকে তালেবানের অপসারণের পর সংগঠনটির প্রধান নেতারা হয় মারা যান নতুবা পালিয়ে যান। তবে অব্যাহত সামরিক অভিযান সত্ত্বেও আল-কায়েদা পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন হয়নি। বরং সংগঠনটি বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে তাদের কার্যক্রম বিস্তারের কৌশল গ্রহণ করেছে। আল-কায়েদা পুনর্গঠনে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করেছে ২০০৩ সালে ইরাকে মার্কিন সামরিক হস্তক্ষেপ এবং পরবর্তী নৈরাজ্যকর রাজনৈতিক পরিস্থিতি।

আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের তথ্যমতে, ইরাকে সাদ্দাম হোসেনের পতনের পর ‘ডিবাথিফিকেশনের’ নামে সুসংগঠিত সেনাবাহিনীকে নিষ্ক্রিয় করে হাজার হাজার প্রশিক্ষিত সেনাসদস্য ও কর্মকর্তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়। পাশাপাশি ভেঙে পড়ে মৌলিক সেবাব্যবস্থা, নিরাপত্তাব্যবস্থা। এতে উগ্রপন্থীদের জন্য একধরনের অনুকূল পরিবেশ হয়।

প্রাথমিকভাবে সাদ্দাম হোসেনের সমর্থকেরা যে প্রতিরোধ তৈরি করেছিল, তা সামরিকভাবে মোকাবিলা করার সময় মার্কিন বাহিনীর আচরণ, বিশেষ করে আবু গারিবের মতো বিভিন্ন কারাগারে নির্যাতনের ঘটনা ইরাকিদের এই বিদ্রোহীদের প্রতি সহানুভূতিশীল করে তোলে।

এই পরিস্থিতির ব্যাপক অবনতি ঘটে ২০০৫ সালে ইরাকে রাজনৈতিক প্রক্রিয়া শুরু করার পর। প্রথমত, ২০০৫ সালের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে সুন্নি মুসলিম জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ না করা এবং ডিসেম্বরের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত নুর-ই-আল মালিকি সরকারের নীতিগুলো, যা সংখ্যালঘু সুন্নিদের রাজনীতি ও অর্থনীতিতে অংশগ্রহণের পথ সীমিত করে দেয়। পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে ইরাকের এত দিনের প্রতিষ্ঠিত প্রশাসনিক ও সশস্ত্র বাহিনীর সম্পূর্ণ কাঠামো যুক্তরাষ্ট্র ভেঙে ফেলে।
৯/১১ পরবর্তী সময়ে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে যুক্তরাষ্ট্রের যে ফল প্রত্যাশা ছিল, ঘটে তার উল্টোটা। জঙ্গিবাদ মাথাচাড়া দেয়। সারা বিশ্বে তা ছড়িয়ে পড়ে।

আল–কায়েদার দলছুট সশস্ত্র জঙ্গিরা পরে জঙ্গিগোষ্ঠী আইএসে (ইসলামিক স্টেট) যোগ দেয়। যদিও এই জঙ্গিগোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠাতা আবু বকর আল বাগদাদি ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের কারাগারে বন্দী ছিলেন অনেক দিন। সেখান থেকে বেরিয়ে এসেই তিনি জঙ্গিবাদের দিকে ঝোঁকেন। এরপর ইরাক ও সিরিয়ার বিশাল ভূখণ্ডের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে খেলাফত প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয় জঙ্গি সংগঠনটি। আইএসের এই আকস্মিক উত্থানে বিশ্বব্যাপী জঙ্গি সংগঠনগুলোকে চাঙা করে দেয়।

যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতায় এসেই প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন আফগানিস্তান থেকে পুরোপুরি সেনা প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন। আর তারপরই বিশ্ব দেখল, তালেবান কত দ্রুততায় আবার আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ নিল।

তালেবান যে এত দ্রুত ক্ষমতা দখল করতে পারবে, অনেকেরই ধারণার বাইরে ছিল। এদিকে ইরাকের পরিস্থিতি এখন আরও ভয়ংকর। আইএসের উত্থান ও পতনের মধ্য দিয়ে ইরাক এখন ইরান সমর্থিত মিলিশিয়াদের জন্য খোলা ময়দান হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ওয়াশিংটনের কিছু বিশ্লেষকের মতে, মার্কিন নীতিনির্ধারকদের অভিধান থেকে ‘জাতি গঠন’ ‘নতুন সরকার বসাতে সাহায্য করার’ মতো বিষয় বাদ দেওয়া উচিত। আফগানিস্তান এবং ইরাকে জাতিগত ও সাম্প্রদায়িক বিভাজনকে যুক্তরাষ্ট্র বা অন্যান্য পশ্চিমা শক্তি কখনোই ঠিক করতে পারার মতো পরিস্থিতিতে ছিল না। বরং নতুন সরকার গড়তে সহায়তা, নির্বাচন আয়োজন করা কিংবা স্বল্প সময়ের মধ্যে সাহায্য হিসেবে প্রচুর পরিমাণ অর্থের জোগান দেওয়া হিতে বিপরীত হয়েছে। গণতন্ত্রের বিকাশের পরিবর্তে প্রশাসনকে ব্যাপক দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়তে সাহায্য করেছে।

ইরাক ও আফগানিস্তানের নতুন গণতন্ত্রে প্রকৃত জাতীয়তাবোধের ঘাটতি ছিল, যা স্থানীয়, জাতিগত এবং সাম্প্রদায়িক মনোভাবকে প্রভাবিত করেছিল। পূর্ববর্তী শাসকদের পতনের পর অনেক গোষ্ঠী ও উপদল নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। বাইরে থেকে আসা অর্থ সাহায্য এসব সংগঠনকে আরও পুষ্ট করেছে। এসব গোষ্ঠীর মধ্যে রয়েছে আফগানিস্তানের পশতু ও ইরাকের সুন্নি আরবরা।

তালেবান ২০ বছর পর আবার ক্ষমতায় ফিরতে পারলেও ইরাকে সুন্নি আরবদের পক্ষে তা করে দেখানো কঠিন হবে। কারণ, শিয়া ও কুর্দিরা সেখানকার জনগণের ৮০ শতাংশ। এ ছাড়া সেখানে এখন ইরানের ব্যাপক প্রভাব। ওই অঞ্চলে ইরান সমর্থিত মিলিশিয়ারা এখন আরব অঞ্চলজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। লেবানন ও ইয়েমেনের মতোই ইরাক এখন ফাঁপা এক রাষ্ট্রের রূপ নিয়েছে। ফলে সাধারণ মানুষ সেখানে হয় বাস্তুচ্যুত কিংবা হতাহত হচ্ছে, নতুবা ঝুঁকে পড়ছে জঙ্গিবাদে।

অনেকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, যুক্তরাষ্ট্র যদি যুদ্ধের নীতি নিয়ে অগ্রসর না হতো, তাহলে কী ঘটত। তালেবান ও সাদ্দাম হোসেনকে উৎখাত করার পর যদি মার্কিনরা আফগানিস্তান ও ইরাকে না থাকত, তাহলেই–বা কী হতো? দুটি যুদ্ধেই প্রাথমিকভাবে মার্কিন বাহিনী সফল হয়েছে। পাকিস্তানের কোয়েটায় মার্কিন বাহিনীর গোপন এক ঝটিকা অভিযানে নিহত হয়েছেন আল-কায়েদা নেতা ওসামা বিন লাদেন। সিরিয়াতেও মার্কিন বাহিনীর এমনই এক অভিযানে প্রাণ হারিয়েছেন আইএসের প্রতিষ্ঠাতা আবু বকর আল বাগদাদি। আল-কায়েদা ও আইএস দমনে অনেকাংশে সফল হওয়ার পরও মার্কিন বাহিনী থেকে গেছে আফগানিস্তান ও ইরাকে। চেষ্টা করেছে নিজেদের পছন্দ অনুযায়ী গণতান্ত্রিক সরকার গঠনের। ফলে দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধে জড়িয়ে গেছে তারা।
তবে মার্কিন বাহিনী যদি প্রাথমিক সাফল্য পাওয়ার পরপরই ওই দুই দেশ থেকে সরে আসত, তাহলেও ফলাফলে খুব একটা পরিবর্তন আসত না। কারণ, আফগানিস্তানে মার্কিন বাহিনী সরে যাওয়ার পরপরই দৃশ্যপটে পুরোদমে হাজির হতো তালেবান, যেমনটা এখন ঘটেছে। তবে দেশটির উত্তরাঞ্চলে যেখানে আবদুল রশিদ দোস্তুমের নর্দান অ্যালায়েন্সের প্রতাপ ছিল, সেখানে খুব বেশি প্রভাব ফেলতে পারত না তালেবানরা।

বিস্ময়করভাবে তালেবানরা এখন আরও শক্তিশালী। দৃশ্যত মার্কিন বাহিনীর ২০ বছরের অভিযানে তারা এতটুকুও দুর্বল হয়নি। সেদিক থেকে ২০ বছরের এই যুদ্ধের ফলাফল লাখো প্রাণহানি আর বিপুল অর্থের অপচয় ছাড়া কিছুই নয় বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।

ইরাকেও যে অন্য রকম ফল হতো, তা কিন্তু নয়। ২০০৩ সালে সাদ্দাম হোসেনের পতনের পর জোট সরকার যদি দ্রুত ভেঙে যেত, তাহলে কুর্দিদের দমনে দেশটিতে হামলা চালাত তুরস্ক, যা তারা ২০১৯-২০ সালে করেছে। এ ছাড়া ইরাকি শিয়া ও সুন্নি আরব উগ্রপন্থীদের হুমকির পরিবর্তে ইরানের সরাসরি হস্তক্ষেপ ঘটতে পারত। দেশটিতে কয়েক দশক ধরে বাথ পার্টির পীড়নে ইরাকিদের মধ্যে প্রবল বিভাজনের সৃষ্টি হয়েছিল। মার্কিন বাহিনীর অভিযানের পর তা না কমে উল্টো প্রকট হয়েছে।
আল–জাজিরার এক মন্তব্য প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আফগানিস্তান কিংবা ইরাকে যে লক্ষ্য নিয়ে মার্কিন অভিযান শুরু হয়েছিল, তা অর্জন হয়নি বললেই চলে। উল্টো লাখো সাধারণ মানুষের প্রাণ গেছে, বাস্তুচ্যুত হয়েছে অনেকে।

৯/১১ হামলার পর সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধ শুরুর পর উল্টো বিশ্বজুড়ে জঙ্গিবাদ যেন ছড়িয়ে পড়ে। এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকাসহ বিভিন্ন অঞ্চলে আইএস, আল-কায়েদার পাশাপাশি আল-শাবাবের মতো জঙ্গিগোষ্ঠীর উত্থান ঘটে।

সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের ইন্টারন্যাশনাল সিকিউরিটি প্রোগ্রামের পরিচালক শেঠ জি জোন্স বলেন, তারা (আল–কায়েদা) ২০০১ সালের চেয়ে বেশি বিস্তৃত হয়েছে। আফগানিস্তানের মতো এলাকা থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের ঘটনা এসব নেটওয়ার্কের শক্তি আরও বাড়তে সাহায্য করবে।

তথ্যসূত্র: আরব নিউজ, এএফপি, আল জাজিরা

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *