মহাবিশ্বের বৈচিত্র্যময় গ্রহ পৃথিবী। এর গঠন, বিকাশ, অবস্থিতি সবকিছুই বৈচিত্র্যে ভরা। এ বৈচিত্র্যের অংশ হলো আলো, বাতাস, মাটি, উদ্ভিদ, পানি, প্রাণী প্রভৃতি। নান্দনিক প্রাণপ্রবাহের বৈচিত্র্যপূর্ণ আবেশ, প্রতিবেশ, পরিবেশ। শীত-গরম-বর্ষা, আলো-আঁধারি, প্রাণের সংলাপ, বিলাপ, বিলাস সবকিছুই পৃথিবীকে সমৃদ্ধ করেছে। বহুমাত্রিকতা দিয়েছে। প্রাণকে ঘিরে পৃথিবী পরিপূর্ণ হয়েছে। আর পৃথিবীকে আশ্রয় করে প্রাণের অনুপম বিকাশ ঘটেছে। প্রাণের স্পন্দনই পৃথিবীকে রসময়, গন্ধময়, বর্ণময়, রূপশ্রী করেছে। এভাবেই পৃথিবী ও প্রাণের মাঝে অবিচ্ছিন্ন মায়াবী বন্ধন সৃষ্টি হয়েছে। এটি ছান্দিক, দ্বান্দ্বিক, নান্দনিক, অনুপম, অবিচ্ছিন্ন।
প্রাণের এই পৃথিবীকে ঘিরে যে বিশাল বায়ুুম-ল, তা প্রধানত চারভাগে বিভক্ত। ট্রপোস্ফিয়ার, স্ট্রাটোস্ফিয়ার, মেসোস্ফিয়ার, থার্মোস্ফিয়ার। আমাদের বসবাস করা পৃথিবী থেকে উর্ধাকাশে প্রায় ১১ থেকে ১৫ কিলোমিটার পৃথিবীর চারদিকে বিস্তৃত, বেষ্টিত অঞ্চল হল ট্রপোস্ফিয়ার। এ অঞ্চল পৃথিবীর প্রায় সব প্রাকৃতিক ঘটনা, রটনা, বিপর্যয়, বিভ্রান্তি, অস্থিরতা, প্রভৃতির সাথে যুক্ত। মেঘ বৃষ্টির খেলা, মেলা, বিদ্যুৎ, বাষ্প, ঝড়ঝঞ্ঝা, সিডর-সাইক্লোন, দোলাচলা সবকিছুকে প্রভাবিত, প্ররোচিত করে এ অঞ্চল। বিভিন্ন গ্যাসকণা, বালুকণা, কঠিন বস্তু কণার, জলকণা, মেঘ, শিলা, কুয়াশা-ধোঁয়াশা, প্রভৃতি বিচ্ছিন্ন কণা, অণু-পরমাণু, আয়ন, রেডিক্যাল, ফ্রিরেডিকেল এ অঞ্চলের পরিপূর্ণ থাকে। পৃথিবীর বহুমাত্রিক কাজকর্মের নির্যাস এই অঞ্চল ধারণ করে।
ট্রপোস্ফিয়ারের উপর থেকে পৃথিবীর চারিদিকে বেস্টন করা অঞ্চলের নাম স্ট্রাটোস্ফিয়ার। এর বিস্তৃতি ট্রপোস্ফিয়ারের উপরে চারিদিক বেষ্টিত ৪০ থেকে ৪৫ কিলোমিটার অঞ্চল জুড়ে। স্ট্রাটোস্ফিয়ারকে ঘিরে পৃথিবীর চারিদিকে যে স্তর, ঘননীল-তাই ওজোন স্তর। এটি পৃথিবীর সুরক্ষা ঢাল- ওজোন স্তরে।
ওজোন স্তর সূর্যের আলোর অত্যন্ত ক্ষতিকর রশ্মি শোষণ করে আটকে দেয় বা ফেরত পাঠায়, পৃথিবীতে আসতে বাধা দেয়। পৃথিবীর প্রাণকে সুরক্ষিত করে। পৃথিবীর জীব, সম্পদ, এসব  ক্ষতিকর রশ্মির প্রভাব, প্রতিক্রিয়া থেকে বেঁচে যায়। বেঁচে আসছে। বেঁচে থাকছে। বায়ুুম-লের ক্ষতিকর একশ্রেণির রাসায়নিক যৌগ, পদার্থসমূহ বায়ুুম-লের ওজোন স্তরকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। বিক্রিয়ার মাধ্যমে ওজন অণুকে ভেঙে অন্যান্য অণুতে পরিণত করে। এভাবে ওজোন স্তর ক্ষয় প্রাপ্ত হতে থাকে। ওজোন স্তরের ক্ষয় কিংবা ধ্বংস প্রাপ্ত হওয়া পৃথিবীর প্রাণের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর, অত্যন্ত ধ্বংসাত্মক। এই ধ্বংস প্রক্রিয়াকে ঠেকানোর জন্য ভিয়েনা কনভেনশনের আওতায় ওজোনস্তর ক্ষয়কারী পদার্থ নিয়ন্ত্রণের ওপর মন্ট্রিল প্রটোকল গৃহীত হয়। তারিখটা ১৯৮৭ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর। দিনটি পালিত হয় বিশ্ব ওজন দিবস হিসাবে।
৩৩ বছরে পড়েছে বিশ্ব ওজন দিবস পালনের প্রক্রিয়া। আন্তর্জাতিক ওজোন রক্ষা দিবস। বাংলাদেশ ১৯৯০ সালে এই প্রটোকলে স্বাক্ষর করে এবং সেদিন থেকেই এই দিবসটি পালনের দায় বাংলাদেশের উপর আরোপিত হয়।
ক্লোরো ফ্লোরো কার্বন হলো কার্বন, ক্লোরিন, ফ্লোরিন এর জৈব যৌগ। পরিবেশে এগুলো দীর্ঘকালব্যাপী অবস্থান করে এবং ওজোন স্তরের ওজনের সাথে বিক্রিয়া করে ওজনকে অক্সিজেন সহ অন্যান্য অণুতে পরিণত করে।
এভাবেই ওজোনস্তরের ধারাবাহিক ক্ষতি করতে থাকে দীর্ঘমেয়াদি এই যৌগগুলো। এ গ্রহের মানুষ তা বুঝে ছিল গত শতাব্দীর শেষ দিকে এসে। ইলেক্ট্রনিক যন্ত্রপাতি থেকে, বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় এই গ্যাসগুলো নিয়মিতই বাতাসে সংযুক্ত হয়।
মানুষ বৃদ্ধির সাথে সাথে পৃথিবীতে বিড়ম্বনাও বেড়ে যায়। ওজনক্ষয়কারি বিভিন্ন বস্তু যেমন- সিএফসি, এইচসিএফসি গ্যাসসমূহ, হ্যালন মিথাইল ব্রোমাইড, বিভিন্ন ব্যবহারিক প্রক্রিয়ায় বৃদ্ধি পেতে থাকে সমগ্র দুনিয়াব্যাপী। সিএফসি গ্যাসসমূহের বিভিন্ন যৌগ হলো সিএফসি-১১, সিএফসি-১২, সিএফসি-১১৩, ১১৪, এইচসিএফসি -২২ প্রভৃতি। সিএফসিসমূহ পৃথিবীর জীবনকে মহাসঙ্কটের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। মানুষও তা উপলব্ধি করেছে সময় পার করে। ওজন বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য যে দিবস, বিশ্ব ওজন দিবস, তারও ৩৩ তম বার্ষিকী চলছে। দেশে দেশে মানুষের সচেতনতার হার বৃদ্ধির মাত্রা ব্যাপক নয়। অস্তিত্বকে, পৃথিবীর জীবনকে টিকিয়ে রাখার জন্য প্রচার-প্রচারণা, সচেতনতা সৃষ্টির প্রয়াস নেয়া হয়েছে। আলোচনা-পর্যালোচনায় জীবন ও অস্তিত্বের, সংকট ও সংশয়ের, রোগ ও ব্যাধির বিভিন্ন বিপন্নতাকে তুলে ধরা হচ্ছে।
মহাসঙ্কটের পরও এদের ব্যবহার উৎপাদন থেমে থাকেনি। উন্নত ও অনুন্নত বিশ্বের বিভিন্ন মেয়াদে সিএফসি এর উৎপাদন ও ব্যবহার সীমিত করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এই সিএফসি সমূহ ইলেক্ট্রনিক্স-সামগ্রী ধোয়া-মোছার কাজে, চিকিৎসাসামগ্রী ধোয়া-মোছার কাজে, এরোসল সামগ্রী তৈরিতে ব্যবহার করা হয়। ফল ও সবজির কীটনাশক রোধে ডিসপ্লে করা হয় তাতেও সিএফসি গ্যাস থাকে। বাসা কিংবা অফিস ঘরের তাপমাত্রা নিরোধক ইনসুলেটর, ফোম প্রস্তুতের সিএফসি ব্যবহার করা হয়। ক্যান্সার থ্যারাফিতে, খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণে, হিমায়িত করতে, ধোয়া সৃষ্টিতে, তামাকসামগ্রী উৎপাদনে, কৃষি রসায়নে সিএফসির ব্যবহার প্রচুর। এয়ারকুলার, রেফ্রিজারেটর, ফটোকপিয়ার প্রভৃতিতে ওজোন ক্ষয়কারি গ্যাসের ব্যবহার অত্যন্ত বেশি।
সংকটকে চিহ্নিত করা হয়েছে। সংকটের উৎসকে চেনা গেছে। তবুও সভ্যতার অগ্রগতি ওজোন স্তরের ওজনের ক্ষয়কারী রাসায়নিকের ব্যবহারকে নির্মূল করতে পারেনি। অস্তিত্বের বিপরীতে অবস্থান নিয়ে জীবন বিধ্বংসী প্রক্রিয়ায় মানবসভ্যতাকে এগিয়ে নিতে চায় মানুষ। অর্জন করতে চায় জীবনের জন্য, জীবিকার জন্য, বেঁচে থাকার জন্য প্রশান্তি, সুখ-সমৃদ্ধি। জীবনকে বিপন্ন করে জীবন ও জীবিকার স্বপ্ন। পৃথিবীর সভ্যতাকে এগিয়ে নেবার প্রয়াস। কল্পনাকেও হার মানায় মানুষের এই ধরনের অগ্রযাত্রা। সিএফসি এর সাথে সূর্যালোক আল্ট্রাভায়োলেট রে বিক্রিয়া করে ক্লোরিন বিমুক্ত করে। বিমুক্ত এই ক্লোরিন ওজোন স্তর ধ্বংস করে। একটি ক্লোরিন অণু প্রায় এক লক্ষ ওজন অনুকে ধ্বংস করে। ওজোন স্তর না থাকলে পৃথিবীতে আল্ট্রাভায়োলেট রশ্মির পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। জীবের জৈবনিক প্রক্রিয়ায় বিপরীত প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। চোখে ছানি পড়া, মারাত্মক ত্বকের ক্যান্সার সৃষ্টি, ভিটামিন ডি এর উৎপাদন বৃদ্ধিসহ একই সাথে জীব ও ফসলের উপর প্রভাব পড়ে।
প্রতিটি মানুষের উচিত, এই অবস্থা থেকে রক্ষার জন্য সূর্যের আলো থেকে নিজেকে সহনীয় মাত্রায় সুরক্ষিত করা। চোখ এবং চামড়ার ক্ষতি থেকে নিজেকে সুরক্ষা করা। ঘরের বাইরে সানগ্লাস এবং সানস্ক্রিন ক্রিম ব্যবহার করা। সুরক্ষাকারী পোশাক পড়া। মাথায় হেড ব্যবহার করা। নিজের ছায়ার দৈর্ঘ্য দেখে তাপমাত্রা অনুমান করা। সূর্যের বিপরীতে নিজের ছায়া বেশি ছোট হলে, ধরে নিতে হয় তাপমাত্রায় আল্ট্রাভায়োলেট রশ্মির প্রভাব আছে। তখন সুরক্ষা সামগ্রি ব্যবহার করা উচিত নিজেকে সুরক্ষিত করার জন্য।
বায়ুুম-লে দীর্ঘ বছর যাবত অবস্থান করে সিএফসি যৌগসমূহ। মনে করা হয় ২০৭৫ সাল নাগাদ পৃথিবীতে শুধু ত্বকের ক্যান্সার বিড়ম্বনা নিয়ে জন্ম নেবে প্রায় ৬০ মিলিয়ন মানুষ। উষ্ণম-লীয় মানুষের জন্য এটা হবে দুর্ভাগ্যজনক। এর সাথে যুক্ত হবে অন্যান্য সঙ্কটগুলো। সুতরাং সময় থাকতে আমাদের সতর্ক হতে হবে নিজেদের সুরক্ষার জন্য। পৃথিবীতে প্রাণের অস্তিত্বকে সুরক্ষিত, টেকসই এবং দীর্ঘমেয়াদী করার জন্য আমাদের প্রস্তুত হতে হবে সতর্কতার সাথে। বিশ্ব ওজন দিবসের এবারের প্রতিপাদ্য- জীবনের জন্য ওজন: ওজোন স্তর সংরক্ষণের ৩৫ বছর। আমরা সংকটের সাথে কম সময় অতিবাহিত করিনি।
গত মার্চ থেকে বিশ্বে মহামারী কভিড-১৯ এর বিপর্যয় বিশ্বের দেশে দেশে মানুষকে ঘরবন্দি করেছে। মানুষ ঘরবন্দী হতে বাধ্য হয়েছে। রাস্তাঘাটের যানবাহনের বিভিন্ন বিপর্যয় বাতাসকে দূষিত করেছে কম। শিল্প-কারখানা থেকে ক্ষতিকর ধোয়া, বিপর্যয়ের বেসাতি হয়েছে কম। সারা দুনিয়ার রাসায়নিক শিল্প কর্ম সাময়িকভাবে স্থগিত হয়েছে, কমে গিয়েছে। পৃথিবীর অপরাপর প্রাণীসমূহের ভিতরে  উল্লাস, উদ্দীপনা, সাচ্ছন্দ্য, মুখর অবস্থা লক্ষ্য করা গেছে বিশ্বব্যাপী। তেমনি আকাশ, বাতাস, দূষকের জঞ্জাল থেকে সাময়িক মুক্তি পেয়েছে। এমনই একটি পরিবেশে দক্ষিণ মেরু অঞ্চলের আকাশে ওজোন স্তরের পুরুত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে বলে বিজ্ঞানীরা পরীক্ষা করে দেখেছে। ওই সময়গুলোতে সিএফসি, হ্যালোন, এইচসিএফসির ব্যবহার নিশ্চয়ই কমে গিয়েছিল পৃথিবীব্যাপী।
পৃথিবীতে জীবনের অস্তিত্বকে সুরক্ষিত করতে হলে পৃথিবীর পরিচর্যা করতে হবে। পরিচর্যার মধ্যদিয়েই পৃথিবীর সংশয়, সংকটগুলোকে দূর করতে হবে। সঙ্কট দূর করার মধ্য দিয়ে পৃথিবীকে নিরাপদ করতে হবে। নিরাপদ করতে হবে ওজোন স্তরকে। আমাদের প্রাণের পৃথিবীতে জীবনের চাষ করতে আসুন আমরা ওজোনস্তর ক্ষয়কারী পদার্থের ব্যবহার সীমিত করি। নিঃশেষ করি।

ড. মুহাম্মদ ইদ্রিস আলি মুক্তিযোদ্ধা, অধ্যাপক, কর্ণফুলী গবেষক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *